
জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ তথ্য জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। আমি ঘোষণা দিয়েছি, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন যাতে উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়, সে জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, গত বছর আগস্টে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তিতে আমরা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলাম। এখন আমাদের মেয়াদের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আমরা এসে পৌঁছেছি। সরকারের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব ছিল তিনটি—জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করা, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম আমরা এগিয়ে নিচ্ছি। এ লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শিগগিরই তাদের প্রথম রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছে। আরও কয়েকটি মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ আদালতগুলোতেও জুলাই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত বিচার শুরু হয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গুমের মতো নৃশংস অপরাধের বিচারও শুরু হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে, সংস্কারের ক্ষেত্রেও আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। অন্তর্বর্তী সরকার নিজ উদ্যোগে বা বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করেছে, কিছু কাজ এখনও চলমান। অধ্যাদেশ জারি বা বিদ্যমান আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচার ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ডিজিটালাইজেশন সম্প্রসারণ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, এসব সংস্কার ভবিষ্যতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রাখবে। আশা করি, আগামী নির্বাচিত সরকার সংসদে আলোচনার মাধ্যমে এসব সংস্কার গ্রহণ করবে।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত প্রায় নয় মাস ধরে নিরলসভাবে কাজ করেছে। এই সময়ে কমিশন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বসেছে। অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে রাজনৈতিক নেতারা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেছেন, মতের পার্থক্য কমানোর চেষ্টা করেছেন এবং অনেক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। দেশবাসী সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেছেন, যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসেও এক বিরল ঘটনা। আমি ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এই অসাধারণ গণতান্ত্রিক চর্চার সফল আয়োজনের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ঐকমত্য কমিশনের প্রণীত জুলাই সনদে সংবিধান সংক্রান্ত ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে—এটি একটি ঐতিহাসিক অর্জন। কিছু প্রস্তাবে সামান্য মতভেদ থাকলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য ও নীতিতে সবাই একমত। পার্থক্য শুধু পদ্ধতিগত—কেউ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, কেউ আইনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, প্রকাশ্যে যতটা মতবিরোধ দেখা যায়, বাস্তবে তা খুব গভীর নয়। এটি আমাদের জন্য এক অনন্য অর্জন, যা জাতিকে আরও এগিয়ে যেতে সাহস জোগাবে।
এসব বিবেচনায় নিয়ে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদকে মূল দলিল হিসেবে ধরে অন্তর্বর্তী সরকার আজকের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করেছে। প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর শেষে এটি গেজেট আকারে প্রকাশের পর্যায়ে রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এই আদেশে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে সনদের সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবের ওপর গণভোট আয়োজন এবং পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন।
তিনি বলেন, সবকিছু বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট দুটিই হবে। এতে সংস্কারের গতি ব্যাহত হবে না; বরং নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। গণভোট আয়োজনের জন্য যথাসময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।