রাজধানীর তুরাগ- উত্তরার কাঁচা বাজার গুলোতে বর্তমান সময়ে প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ কমের এ ধরনের অজুহাতে চড়া সবজির খুচরা ও পাইকারি বাজার। স্হানীয় বাজার গুলোতে প্রকারভেদে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া।
দু’সপ্তাহ ব্যবধানে প্রকারভেদে সবজির দাম বেড়েছে ৫ থেকে ২০ টাকা। যার প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারেও। তুরাগ, উত্তরা ও টঙ্গী বাজারে পাইকারি- খুচরা বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সবজি। ভোর থেকেই দরদাম আর কেনাবেচায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে উত্তরার ১০ নং সেক্টর স্ল্যুইচ গেইট ফলের বাজার ও কামার পাড়া কাঁচা বাজার সবজির আৎত। তুরাগের ডিয়াবাড়ী কালা মার্কেট ও চন্ডাল ভোগ এলাকার খুচরা কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ীরা কেউ কেউ ক্রেতাদের বলছে, আমরা একদামেই ক্রয় করি সবজি ; আবার এক দামেই বিক্রিও করি। একটি টাকাও কম দেয়া যাবে না। খবর একাধিক নির্ভরযোগ্য তথ্য সূত্রের।
আজ মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) ইং সকালে দু’টি পাইকারি আড়ৎ এবং বিকেলে স্হানীয় কয়েকটি কাঁচা বাজার সরজমিনে পরিদর্শন করে এসব তথ্য জানা গেছে।
তথ্য অনুসন্ধান ও খোঁজ খবর নিয়ে দেখা যায়, পাইকারিতেই বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বেশিরভাগ সবজি। পাইকারি বাজারে কেজিতে ৫/১০ টাকা বেড়ে পটল ৭০ টাকা। সেটি খুচরা বাজারে ১০০ টাকায় আজ বিক্রি করা হচ্ছে। বেগুন ৭০/৮০ টাকা,
খুচরা বাজারে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে করলা ৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ৭০ টাকা, কাঁচামরিচ ১৮০/২০০ টাকা, টমেটো ১৮০ টাকা ও গাজর ৮০/৯০ টাকায় বেঁচাকেনা হচ্ছে। পাইকারী বাজারে ৮০ টাকার বরবটি খুচরা বাজারে বিক্রি করা হয় ১০০ টাকা। আর ঢ্যাঁড়স কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা । আগাম শিম বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া কয়েকটি সবজির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। ঝিঙে ৫০ টাকা, ধুন্দল ও কচুর লতি ৭০ টাকা, মুখি কচু ৮০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা ও মিষ্টি কুমড়া ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
সচেতন মহল ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছে, সবজি কিনতেই পকেট ফাঁকা! পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। খুচরায় কেজি প্রতি আরও ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। ঊর্ধ্বমুখী এই বাজারে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ক্রেতারা পড়েছেন বিপাকে। যে ব্যক্তি তার পরিবারের জন্য এক কেজি করে সবজি কিনতো, দাম বৃদ্ধির কারণে কিনছে আধা কেজি করে। অনেকে আবার ২৫০ গ্রাম (এক পোয়া) প্রয়োজনের তুলনায় কম কিনে ফিরতে হচ্ছে বাড়ি। কাঁচা মালের দাম আকাশ ছোঁয়া।
ভোক্তারা বলছেন, বাজার মনিটরিং দুর্বল থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শহিদুল ইসলাম শিশির নামে এক শিক্ষার্থী ক্রেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, বাজারে কার্যকরী কোনো মরিটংরিং ব্যবস্থা নেই। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো দাম রাখছেন। আড়ৎদার থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও দোকানদার মিলে গড়ে তুলেছেন বিশাল সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে প্রতিবাদ করা কিংবা দেখারও যেন কেউ নেই।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, দাম চড়া থাকায় একদিকে পুঁজি যেমন বেশি লাগছে, তেমনি বিক্রিও হচ্ছে কম। মো: মিলন নামে এক খুচরা কাঁচা তরকারি ব্যবসায়ী বলেন, সবিজর দাম বাড়ায় ক্রেতারা পরিমাণে কম কিনছেন। এতে বেঁচাকেনা কমে গেছে।
কাঁচা বাজারের আড়ৎদার আনোয়ার হোসেন ও মো: জহির উদ্দিন জানান, আবহাওয়ার তারতম্য ও সরবরাহ কম থাকায় চড়া সবজির বাজার। বৃষ্টির কারণে অনেকের ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। যার কারণে সরবরাহ অনেক কম। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে শীতের সবজি বাজারে আসা শুরু হলে দাম অনেক কমবে।
শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ বলছে, সবজির বাজারে অস্থিরতা, বেশিরভাগের দাম ৮০ টাকার ওপরে।
উত্তরা ও তুরাগের বাজারে সবজির দাম দিন দিন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে অস্থিরতা চললেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই।
আজ মঙ্গলবার সকালে ও বিকেলে তুরাগের ডিয়াবাড়ী, চন্ডাল ভোগ, নলভোগ, খালপাড় ব্রিজ বাজার, ১১ নং সেক্টর বাজার, স্ল্যুইচ গেইট, কামার পাড়া, আব্দুল্লাহপুর, আজমপুর বাজার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ সবজির দাম আগের চেয়ে আরও বেড়ে গেছে। পেঁপে ছাড়া কোনো সবজিই ৭০/৮০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না।
সবজির বাজারে লাউ বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিচ ১০০ থেকে ১১০ টাকা । বেগুনের কেজি উঠেছে ১০০/১৩০ টাকায়, যা অনেক পরিবারের জন্য এখন প্রায় বিলাসদ্রব্যে পরিণত হয়েছে। এছাড়া ঝিঙে ৮০ টাকা, পটল ৯০/১০০ টাকা, ও টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১৮০/২০০ টাকা কেজিতে। ৮০ টাকার বরবটি ৯০/১১০ টাকা, পেঁয়াজ ৮০/৯০ টাকা এবং কাঁচা মরিচ ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ডিয়াবাড়ী কালা মিয়া মার্কেট বাজারে সবজি কিনতে আসা গৃহিণী জুলেখা বেগম ও আমেনা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটা পরিবারের জন্য সামান্য বাজার করতেই এখন হাজার টাকা লাগে। আগে যেখানে তিন-চার ধরনের সবজি কিনতে পারতাম, এখন বাধ্য হয়ে শুধু একটা-দু’টো সবজি নিয়েই ফিরতে হয়। দাম শুনলেই মাথা ঘুরে যায়। এখানকার ব্যবসায়ীরা নাকি একদামে পণ্য কিনে; আবার একদামেই আমাদের কাছে বিক্রি করে থাকে। এক টাকাও কম নেয় না ব্যবসায়ীরা। নিলে নাও; না কিনলে সামনে হাঁট।
তুরাগের নলভোগ কাঁচা বাজারে চাকরিজীবী বলেন, স্বপন ও মনির এ প্রতিবেদককে বলেন, কাঁচা বাজারে গেলে মনে হয় আমরা সাধারণ মানুষ আর কিছুই কিনতে পারব না। বেতনের টাকা গলে যাচ্ছে বাজারেই। সন্তানদের পছন্দের সবজি কিনতে পারছি না, এটা ভীষণ কষ্টের। বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোন মতে সন্তানের খরচ চালাই। আমাদের দুঃখ কষ্ট বুঝার লোক নাই।সবজির বাজারে অস্থিরতা চলছে। দামও আকাশ ছোঁয়া। এক মুঠো লাল, কলমি, পাটশালও ছোট ডাটা শাল ২০ টাকা। এক পিচ লাউ ১০০ টাকা।
অনেকেই বলছে, আমাদের হাতে তো কিছু নেই। চাষিরা ঠিকমতো সরবরাহ দিতে পারছে না, আবার পরিবহন খরচও বেড়েছে। বৃষ্টিতে অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে।
খুচরা মুদি দোকানদার চণ্ডাল ভোগ এলাকার মো: হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিব জানান, আটা-ময়দা ও ডালের দাম এবার কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া ব্যবসা করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের যুক্তি তুলে ধরছেন। ফলে আটা-ময়দা, চাল, ডাল, তৈল, চিনি ও সিগারেট এবং নানান জিনিসপত্রের দাম কমার কোনো সুযোগ নেই। তাই বাজারে দাম তুলনামূলক ভাবে আগের চেয়ে একটু বেশি। তার দোকানে মুখ সেলফ করা ( দাঁড়ি) কাটার এক পিচ ব্লেডের দাম ৫০ টাকা। অথচ পাশের এক দোকান থেকে কিনতে পাওয়া গেল ৪০ টাকায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এমনিতেই হাবিব এর দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলক ভাবে অন্য দোকানের চেয়ে একটু বেশি রাখে। পাশাপাশি তার দু’টি দোকান আছে। দোকানে কর্মচারী আছে ৫/৬ জন।
ব্যবসায়ীরা বলছে, ক্রেতারা আমাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন, কিন্তু আমরা খুচরা ব্যবসায়ী। পাইকারি বাজারেই দাম বেশি। আমাদেরও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। ক্রেতাদের চাপ আমরা বুঝি, কিন্তু নিজেরাও সমস্যায় আছি। সবজির পাশাপাশি ভোক্তাদের স্বস্তি নেই চালের বাজারেও। চালের দাম বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। ভালো মানের মিনিকেটের দাম ৮৫ টাকা কেজি ।
তুরাগ ও উত্তরার গৃহিণীরা বলছেন, শুধু সবজি নয়, চাল, ডাল, মাছ, কাঁচা সবজিসহ সব কিছুর দাম একসঙ্গে বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে মাসে যে টাকায় বাজার হতো, এখন সেই টাকায় অর্ধেকও হয় না। একদিকে বাচ্চাদের পড়াশোনা, অন্যদিকে সংসার-সবকিছু সামলাতে এখন আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধি করছেন। বর্তমান সরকারের এদিকে নজর দেওয়া উচিত।
সংশ্লিররা ও সচেতন মহল বলছে, ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজারে এবার ক্রেতার ওপর চাপ বাড়াচ্ছে আটা, ময়দা, চিনি, তৈল ও মসুর ডাল। বিশেষ করে গত দুই সপ্তাহে কেজিতে আটা-ময়দা ও ডালের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। প্রতি কেজিতে আটা ও ময়দার দাম যথাক্রমে বেড়েছে ৬/৮ টাকা ও ৫-১০ টাকা পর্যন্ত। আর মসুর ডালের দাম বেড়েছে ২০/ ২৫ টাকা পর্যন্ত। বাজারে খোলা আটা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় কেজিতে, যা আগে ছিল ৪০-৪২ টাকা। প্যাকেটজাত আটার দামও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০/১১০ টাকায়। আর খোলা ময়দা এখন ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আগে যা ছিল ৫০ টাকা। প্যাকেটজাত ময়দা ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ১৩০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আটা ও ময়দার সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে। আটা ও ময়দার কিছুটা সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে। নতুন প্যাকেটের স্টক এখনও তেমন একটা বাজারে আসেনি। ফলে দাম কিছুটা বেড়েছে। আমরা বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।
ক্রেতারা বলছে, পরিবারে দৈনন্দিন খরচ সামলানো দিনদিন কঠিন হয়ে পড়েছে। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে নতুন করে চাপ বাড়ল। বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর মনিটরিং করতে হবে। না হলে দাম কমবে না।
এবিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, বানিজ্য উপদেষ্টা, ভুক্তা অধিকার সংরক্ষণের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট মহলের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তুরাগ ও উত্তরার সর্বস্তরের জনগণ।