• ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৯ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

উত্তরায় ফুটপাত থেকে দৈনিক অর্ধকোটি টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৫, ১৭:০৫ অপরাহ্ণ
উত্তরায় ফুটপাত থেকে দৈনিক অর্ধকোটি টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ
সংবাদটি শেয়ার করুন....

রাজধানীর উত্তরা, তুরাগ, বিমানবন্দর, দক্ষিণখান, উত্তরখান ও খিলক্ষেত উত্তরা বিভাগের ছয় থানা এলাকায় গড়ে উঠা অবৈধ ফুটপাত থেকে দৈনিক প্রায় অর্ধ কোটি টাকার ও অধিক চাঁদা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের উত্তরার আব্দুল্লাহপুর ফ্লাইওভারের নিচ থেকে শুরু করে এয়ারপোর্ট, রাজলক্ষ্মী, আজমপুর, হাউজ বিল্ডিং সোনারগাঁও জনপথ সড়ক খালপাড় হয়ে তুরাগের ডিয়াবাড়ী মেট্রোরেল এলাকা, বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে টঙ্গী রেলব্রিজ পর্যন্ত ফুটপাত জুড়ে ছোট-বড় প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার বিভিন্ন ধরনের অবৈধ দোকানপাট রয়েছে। কখনো ঠেলাগাড়িতে, কখনো ভ্যানে, আবার কখনো সরকারি পরিত্যক্ত জায়গায় স্থায়ী ভাবেই সারিসারি দোকান সাজিয়ে বসেছে ব্যবসায়ী ও সংবদ্ধ চক্র । খবর সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশ্বস্থ তথ্য সূত্রের।

সংশ্লিষ্ট তথ্য উপাত্ত, পরিসংখান ও হিসেব মতে- প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা গুনতে হয় ২০০ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা। কোন কোন ক্ষেত্রে আরও বেশি। দৈনিক ২০০ টাকা হিসেবে ১০ হাজার দোকান থেকে চাঁদা উঠে ২০ লাখ টাকা। সেই অনুপাতে ১২ হাজার দোকান থেকে টাকা উঠে ২৪ লাখ টাকা। ৩০০ টাকা হিসাবে ১০ হাজার দোকানে ৩০ লাখ টাকা, ১২ হাজার দোকানে টাকা উঠে ৩৬ লাখ টাকা। ৫০০ টাকা হিসেবে ১০ হাজার দোকানে টাকা উঠে ৫০ লাখ টাকা এবং ১২ হাজার দোকানে দৈনিক চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ লাখ টাকা। এককালীন দোকান বসানোর জন্য দিতে হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কোন কোন ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিমাণ টাকা দিতে হয়। সে হিসাবে দাঁড়ায় প্রায় ১৫ থেকে ১৮ কোটি টাকা।

বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে আজ বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি’র) উত্তরা পূর্ব থানার আওতাধীন এলাকা আব্দুল্লাহপুর ফ্লাইওভারের নিচে দুই থেকে তিন শতাধিক অবৈধ দোকান। আব্দুল্লাহপুর থেকে শুরু করে রেললাইন ব্রিজ বেরিবাধ রোডে রয়েছে সবজি, মাছ – মাংশসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকশ দোকান। অবৈধ ফুটপাত ব্যবসায়ী ছদ্মনাম নুরুল হক এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দোকানী দৈনিক জনতাকে বলেন, এককালীন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে এখানে দোকান নিতে হবে পজিশন অনুযায়ী। তারপর প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আইয়ুব আলী গংদেরকে দিতে হবে। আইয়ুব আলী গংরা এ জায়গার থানা-পুলিশ সবকিছু মেইনটেইন করে থাকে। ট্রাফিক পুলিশকে ৫০ থেকে ১০০ করে দিতে হয় বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের।

ডিএমপি উত্তরা পশ্চিম থানা আওতাধীন এলাকা হাউস বিল্ডিং, নর্থ টাওয়ারের সামনে ও পেছনে, আজিমপুর ও আমির কমপ্লেক্স এর চারপাশে, রাজলক্ষ্মী রাস্তার চারপাশ এলাকা, বিএনএস সেন্টার, রাজউক কলেজের সামনে, জসিমউদ্দীন রোড সংলগ্ন সব জায়গায় রয়েছে অবৈধ দোকান। ফুটপাতের দোকানদার ছদ্মনাম শাহজাহান ও রানা বলেন, প্রথমে এখানে একটি ভ্যান বা আপনাকে বসার জন্য টাকা গুনতে হবে কমপক্ষে ১০ হাজার, ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এরপর প্রতিদিন দিতে হবে খরচ বাবদ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। পুরো এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে ড+র+স্ব+ গংরা। এই এলাকার ফুটপাতের বাপ-মা তারাই; তারা যা বলবে তা-ই হবে। পুলিশের গাড়ি প্রতিদিনই আসে। ট্রাফিক পুলিশ, থানা পুলিশ প্রতিদিনই আসে, দেখে-শুনে চলে যায়।

এদিকে উত্তরা- তুরাগ থানার খালপাড় এলাকায় অসংখ্য অবৈধ ফুটপাত বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। খালপাড় এলাকায় ফুটপাতে দোকানপাট দখল নেওয়ার বাণিজ্য বহুদিন ধরে চলছে। ১২ নং সেক্টর খালপাড়, খালপাড় ব্রিজ ও বড় মসজিদের সামনে ও পিছনে রাস্তার একাংশ দখল করে ব্রিজের ওপরে পুলিশের নাকের ডগায় অবৈধভাবে প্রায় শতাধিক দোকানপাট রয়েছে। এখানে ফলের, চা- পানের, ডাব, খাবার হোটেল, জামা কাপড় সহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সারিসারি রাইদা পরিবহনের গাড়ি (বাস) রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ক্ষুদ্র চা দোকান, সিগারেট ও হোটেল ব্যবসায়ীরা এ প্রতিবেদককে জানান, আপনারা শুধু টাকা দিলেই হবে। পুলিশের গাড়ি আসলে শুধু বললেই হবে ছদ্মনাম ম+ স+ গং এটা নেতার দোকান। প্রত্যেক মাসে মাসে টাকা দিলে তারাই পুলিশের সব ব্যবস্থা করে দিব। এছাড়া তুরাগের ডিয়াবাড়ি মেট্রোরেল এলাকায় রাস্তার উভয় পাশে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো অবৈধ দোকানের ছড়াছড়ি। দেদাচ্ছে চলছে ব্যবসা বাণিজ্যও। দিয়াবাড়ি মেট্রোরেল সংলগ্ন ৭৫ নাম্বার পিলারের সামনে, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর সামনে, পুকুরপাড় মসজিদের সামনে, ডিয়াবাড়ী মডেল হাইস্কুলের সামনে সোনারগাঁও জনপথ সড়কের দু’পাশে রাজউকের পরিত্যক্ত জায়গা দখল করে সহ বিভিন্ন ধরনের দোকান পাট গড়ে তোলা হয়েছে। মেট্রোরেল এলাকাকে কেন্দ্র করে প্রায় ২৫ থেক ৩০টি ফুডকোর্ট দোকান সহ অসংখ্য দোকানপাট রয়েছে।
পাশাপাশি বিমানবন্দর এলাকাতেও চলছে ফুটপাত দখল বাণিজ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এয়ারপোর্ট এলাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীরা এ প্রতিবেদককে বলেন, এখানে জায়গাগুলো হচ্ছে রেলের জায়গা। রেলের আরএমবি প্রতিদিন আমাদের নিকট থেকে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা করে নিয়ে যায়। আর এখানে দোকান লাগানোর জন্য রেলকে দিতে হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। রেল পুলিশ থেকে শুরু করে সবাই ভাগ-বাটোয়ারা করেই খায়। তাই ব্যবসা করতে তেমন একটা সমস্যা হয় না।

এ বিষয়ে বিমানবন্দর রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক কর্মকর্তা নাম পরিচয় গোপন রেখে এ প্রতিবেদককে বলেন, ব্যাপারটি আমাদের জানা ছিল না ; আপনার কাছ থেকে শুনলাম। আশা করি খুব শিগগিরই এসব বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে বিমানবন্দর জোনের পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের বলেন, অবৈধ ফুটপাতের বিষয়ে আমার আওতাধীন এলাকায় কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। সংবাদ পাওয়া মাত্রই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

অপরদিকে উত্তরখান, থানা রোড, দক্ষিণখান, থানা রোড, উত্তরখান মাজার এলাকাসহ পুরো উত্তরা জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব সড়কের ফুটপাত রয়েছে। আশকোনা থেকে শুরু করে দক্ষিণখান বাজার, গাওয়াইর, প্রেমবাগান, কসাইবাড়ী রেলগেইট, কাঁচকুড়া, মৌনারটেক, ফায়দাবাদ, মাষ্টারবাড়ি, চামুরখান ও কোর্টবাড়ি পর্যন্ত। এছাড়া এসব এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ও লেগুনা গাড়ি যানজটের মূল কারণ।

এসব বিষয়ে উত্তরা ১১, ১২, ১৩,১৪ ও ১৫ নম্বর সেক্টরে বসবাসকারী অসংখ্য বাসিন্দা অভিযোগ করে এ প্রতিবেদককে বলেন, উত্তরা- তুরাগে ফুটপাতের প্রভাবে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার পরে তো মনে হয় পুরো উত্তরার ফুটপাত জুড়েই মেলা বসে। ময়লার মোড় থেকে শুরু করে ১১ নং সেক্টর কাঁচা বাজার পর্যন্ত রাস্তার দু’ পাশে সরকারি পরিত্যক্ত প্লট, ব্যক্তিমালিকানা এবং বানিজ্যিক প্লটে টিনসেট বিশাল ফার্নিচার মার্কেট গড়ে উঠেছে। রয়েছে অসংখ্য নিত্যনতুন দোকান। এসব দোকান থেকে প্রতিমাসে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লাখ টাকা টাকা ভাড়া তোলা হয়। এছাড়া ওয়ার্কওয়ে দিয়ে হাঁটা চলার জায়গাটুকু থাকে না। এছাড়া ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লুবানা হাসপাতাল ও বাংলাদেশ মেডিকেল। এখানে রাস্তার পাশে অবৈধ একটি দোকানও কমতে দেখিনি বরং বাড়তে দেখেছি। সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পুরো উত্তরার ফুটপাত থাকে অবৈধ দোকানের দখলে।

এবিষয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, পুলিশের সহযোগিতায় মাঝেমধ্যে সিটি কর্পোরেশন ও রাজউকের পক্ষ থেকে ম্যাজিষ্ট্রেট দিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অবৈধ স্থাপনা ও দোকানপাট গুলো বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়। লিখিত কোন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।