বাংলাদেশে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের খাদ্যতালিকায় পুষ্টিকর খাবারের ঘাটতি এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। ইউনিসেফের ‘শিশু পুষ্টি প্রতিবেদন ২০২৫’-এ শিশুদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে উঠে এসেছে এক উদ্বেগজনক চিত্র। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৩৮ শতাংশ শিশু ডিম ও মাংস খায় না, আর ৪৬ শতাংশ শিশু শাকসবজি ও ফলমূল খায় না। অথচ ৫৯ শতাংশ শিশু নিয়মিত মিষ্টিজাতীয় খাবার ও পানীয় গ্রহণ করে এবং ২০ শতাংশ শিশু খায় লবণাক্ত ও ভাজা খাবার।
ইউনিসেফ জানায়, বিশ্বব্যাপী স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে বর্তমানে স্থূলতা কম ওজনের তুলনায় বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওজন বাড়লেও পুষ্টিহীনতা থেকে যাওয়ায় বিষয়টি দ্বিগুণ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় সস্তা ও সহজলভ্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের কারণে স্থূলতার হার দ্রুত বাড়ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিবেদনে তিনটি বিষয় উঠে এসেছে—শিশুদের (৬ থেকে ২৩ মাস) মধ্যে অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, স্কুল পরিবেশে ফাস্টফুড ও চিনিযুক্ত পানীয়ের প্রভাব এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজনের প্রবণতা।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য ছয় মাস পর থেকে ভারসাম্যপূর্ণ খাবার দেওয়া জরুরি। অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো শিশুর মধ্যে খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। ডিম, মাংস, শাকসবজি, ফলমূল এগুলো তারও প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাঙ্কফুড ও মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি শিশুদের আসক্তি তাদের শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি তৈরি করছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।’
দক্ষিণ এশিয়ার স্কুল এলাকাগুলোতে ইউনিসেফের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, তাজা ফল ও সবজির তুলনায় ফাস্টফুড, প্যাকেটজাত খাবার ও চিনিযুক্ত পানীয় সহজলভ্য। বাংলাদেশের স্কুলে পড়ুয়া ৬৪ শতাংশ কিশোর-কিশোরী স্কুল প্রাঙ্গণে বিজ্ঞাপন দেখে অস্বাস্থ্যকর খাবার কেনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের হিসাবে বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজনের হার প্রায় ৮ শতাংশ। অন্যদিকে, মালদ্বীপে এ হার ৩২ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ বাড়ছে।
অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, ‘ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর প্রধান খাবার মায়ের দুধ। এরপর শিশুকে মানসম্মত খাবার দিতে হবে তার শারীরিক ও মানসিক গঠনের জন্য। কিন্তু আর্থিক সংকট, খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও অভিভাবকদের ব্যস্ততার কারণে শিশুরা প্যাকেটজাত খাবারের ওপর নির্ভর করছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে শিশুদের মস্তিষ্কের সক্ষমতা ও শিক্ষাগত ফলাফল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ‘খাবারের অভ্যাস সবারই পরিবর্তন হচ্ছে। ফাস্টফুডের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। এখানে মানুষকে সচেতন করাই সবচেয়ে জরুরি।’