• ১৪ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি‘কোচিংয়ের কারণে হারালাম কলিজার ধন’

কোচিং বাণিজ্য বন্ধসহ ৯ দাবিতে অভিভাবকদের মানববন্ধন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশিত আগস্ট ১৩, ২০২৫, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি‘কোচিংয়ের কারণে হারালাম কলিজার ধন’
সংবাদটি শেয়ার করুন....

‘মেয়ে বলল, মা কোচিং না করলে মিস আদর করে না। তাই মেয়েকে কোচিংয়ে দিলাম। কিন্তু সেই কোচিংয়ের কারণেই আমার মেয়ে মারা গেল, হারালাম কলিজার ধন। এই কোচিং মেয়ের সর্বনাশ করেছে।’—কথাগুলো বলছিলেন গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে নিহত তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সায়মা আক্তারের মা রীনা আক্তার। গতকাল মঙ্গলবার দিয়াবাড়ী গোলচত্বরে তার সঙ্গে কথা হয়। রীনা আক্তারের করুণ আর্তনাদ—‘আমার মেয়ে আর আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে না, এই কষ্ট আমি কীভাবে সহ্য করব? মন ভারী হলে কারও সঙ্গে কথা বলি না, চলে যাই মেয়ের কবরে। মাথার কাছে বসে মনের সব কথা বলি, চোখের পানি ফেলি। দেড় ঘণ্টা পরে মনটা হালকা হলে বাড়ি ফিরি।’

এদিকে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ, যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের দিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশসহ ৯ দফা দাবি জানিয়েছেন রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যরা মানববন্ধন করে এসব দাবি জানান। এ সময় তাদের হাতে ছিল সন্তানের ছবিযুক্ত প্ল্যাকার্ড, চোখে জল।

গত ১১ মার্চ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে বলা হয়, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস শেষে ও ছুটির দিনে শ্রেণিকক্ষে প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং নিষিদ্ধ। এছাড়া ২০১২ সালে জারি হওয়া ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা’ অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক ১০ শিক্ষার্থীকে পড়ানো যাবে এবং তাদের তথ্য প্রতিষ্ঠান প্রধানকে জানাতে হবে।

কিন্তু এই নীতিমালা উপেক্ষা করে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শ্রেণিকক্ষে দীর্ঘদিন ধরে কোচিং চালু রয়েছে। জানা গেছে, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের নিয়ম করে দিয়েছে—শিক্ষকেরা বাসায় বা বাইরে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না, তবে স্কুলে পড়াতে পারবেন। স্কুল পর্যায়ে ছুটি হয় দুপুর ১টায়, কলেজ পর্যায়ে ১টা ৪০ মিনিটে। স্কুলের কোচিং শুরু হয় দেড়টায়, কলেজের ২টায়।

আহত এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ‘আমার ভাতিজা ১টায় ছুটি পেয়েছিল, কিন্তু কোচিং করতে স্কুলে অপেক্ষা করছিল। বাধ্যতামূলক না হলে সে আহত হতো না।’

অভিভাবকদের ৯ দাবি

১) সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২) সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।
৩) সরকারের পক্ষ থেকে নিহত শিশুর পরিবারকে ৫ কোটি টাকা এবং আহতদের ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৪) স্কুলের পক্ষ থেকে নিহত শিশুর পরিবারকে ২ কোটি টাকা এবং আহতদের ১ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হবে।
৫) রানওয়ে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরাতে হবে বা রানওয়ে স্থানান্তর করতে হবে।
৬) কোচিং ব্যবসার মূল হোতা স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষিকাকে (মিস খাদিজা) ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করে বিচার করতে হবে।
৭) স্কুলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অভিভাবকদের দেখাতে হবে।
৮) বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ জনশূন্য এলাকায় করতে হবে।
৯) মানববন্ধনের সময় অভিভাবকের গায়ে হাত তোলা শিক্ষক কনককে অপসারণ করতে হবে।

কোচিং না করলে মিসরা আদর করত না

নিহত মারিয়াম উম্মে আফিয়ার মা তামিমা আক্তার বলেন, ‘এখানে যে বাচ্চাগুলো মারা গেছে, সবাই কোচিংয়ের শিক্ষার্থী। এত চাপ অন্য কোথাও নেই। পরীক্ষায় খারাপ করিয়ে কোচিংয়ের জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমার মেয়ে বলেছিল, আমি কোচিং না করলে মিসরা আদর করে না।’

মানসিক চাপ দিয়ে কোচিং করানো হয়

নিহত বোরহান উদ্দীন বাপ্পীর বাবা আবু শাহীন বলেন, ‘শিক্ষকেরা বলেন, বাচ্চা পড়াশোনায় ভালো না, এভাবে মানসিক চাপ দিয়ে কোচিং করায়।’ তার ছোট ছেলেকেও কোচিংয়ে ভর্তি করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে।

কোচিং ব্যবসার মূল হোতা

এক অভিভাবক জানান, স্কুল শাখার প্রধান খাদিজা মিস এই ব্যবসার মূল হোতা। নিহত শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরী বারবার নিষেধ করলেও তিনি শোনেননি, এ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও ছিল।

শিক্ষকের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা

মানববন্ধনে অভিভাবকেরা বলেন, ‘আমরা মারামারি করতে আসিনি, এসেছিলাম মানববন্ধন করতে। অথচ একজন শিক্ষক অভিভাবকের গায়ে হাত তুলেছেন।’ এ ঘটনায় ৮ দফার সঙ্গে আরও একটি দাবি যোগ করা হয়—অভিযুক্ত শিক্ষকের অপসারণ।

অভিভাবকেরা স্লোগান দেন—‘কোচিংয়ের নামে ব্যবসা, বন্ধ কর’, ‘ফুল-পাখি সব পুড়ল কেন, জবাব চাই’, ‘বিমান মায়ের বুক খালি করেছে’, ‘শিক্ষা না ব্যবসা—শিক্ষা চাই’।