তানহা শেখ, সময়ের উদীয়মান, তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে যিনি তান নামেই বেশি পরিচিত। সম্প্রতি আলোকিতে অনুষ্ঠিত আর্কা ফ্যাশন উইকে তানহার ফ্যাশন লেবেল ‘তান’-এর কালেকশন খুব আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে শো-স্টপার রুনা খানের পরা ‘অ্যাস্ট্রিয়া’ কালেকশনের আউটফিট নিয়ে যেন আলোচনা-সমালোচনা থামছেই না।

শান্তা মরিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাশন ডিজাইনের উপর মাস্টার্স শেষ করেছেন তানহা। এরপর ২০১৯ সাল থেকে প্রফেশনালি কাজ শুরু করেন। প্রথম থেকে তানহা এই সিদ্ধান্তে দৃঢ় ছিলেন যে, তিনি একজন সাসটেইনেবল ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করবেন। বাংলা ট্রিবিউনের সাথে একান্ত আলাপে উঠে এসেছে তানহার ডিজাইন, মোটিভ, প্যাশনসহ বিভিন্ন বিষয়।

তানহা শেখ

ডিজাইনে কোন বিষয়টি তানহা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তানহা বলেন, ‘দেখুন, আমাজের সমাজে যে কনভেনশনাল ফ্যাশন চলে আসছে,  তার বাইরে গিয়ে আমি সবসময় কাজ করতে চেয়েছি। সেইসাথে গ্লোবাল ট্রেন্ডকে আমি সবসময় গুরুত্ব দেই। আমি এখন পর্যন্ত যতগুলো কালেকশন করেছি, সবগুলোই প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে সংযোগ সেটিকে আমি সবসময় গুরুত্ব দেই যা আমার পোশাকে উঠে আসে।’

তানহা শেখের ডিজাইনের আউইটফিটে রুনা খান

এর আগে বাউল ঘরানার কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করেছিলেন তানহা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাউলদের যে ফিলোসফি, তার উপর ভিত্তি করে একটি কাজ করেছিলাম। এবারও খুব কাছাকাছি। আর্কার কালেকশনের ধারণা নিয়েছি ‘ইউনিভার্স’ বা ‘কসমিক কানেকশন টু হিউম্যান’- এই ধারণা থেকে। অর্থাৎ পৃথিবীর সাথে মানুষের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সেটিই গুরুত্ব দিয়েছি। সেই হিসেবে থিমের নাম ছিল ‘অ্যাস্ট্রিয়া।’

“গ্রিক মিথোলজিক্যাল দেবী হলেন ‘অ্যাস্ট্রিয়া’। মানুষের শরীরের সাথে প্রকৃতি বা পৃথিবীর একটি সংযোগ, এটাকে ধারণ করেন এই দেবী। শুদ্ধতা, ন্যায়বিচারের প্রতীক তিনি। যেহেতু আমি সেখান থেকেই ধারণা নিয়েছি তাই থিমের নামটি ‘অ্যাস্ট্রিয়া’ রেখেছি। প্রকৃতি থেকে আমি যেমন ধারণা নেই, সেইসাথে বাংলাদেশি ফেব্রিক আমার কালেকশনে গুরুত্ব পায়। কালিদাস কর্মকার নামে আমাদের একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন, কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন। আমাদের দেশে মর্ডান আর্টকে উপস্থান করা শুরু করেন যেসব শিল্পী, কালীদাস কর্মকার ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। উনার কাজগুলো খুবই এবস্ট্রাক্ট ফরমেশনে করা। ফোক বা মিথলজিক্যাল ধারণা, দেশীয় মোটিভ, বাংলা অক্ষর সেখানে উঠে এসেছে। সেখান থেকেও আমি ধারণা নিয়েছি।”

অ্যাপ্রিকট অরেঞ্জ কালারের ব্যবহার
ওয়াবি-সাবি নামে একটি জাপানিজ নন্দনতাত্ত্বিক ফিলোসফি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে অসমতা, রুক্ষতা, সরলতা, অর্থনীতি, কঠোরতা, বিনয়, ঘনিষ্ঠতা। সেই সাথে প্রাকৃতিক বস্তু ও প্রকৃতির শক্তি উভয়ের সম্মিলিত রূপ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই ‘ওয়াবি-সাবি’ থেকেও তানহা আইডিয়া নিয়েছেন বলে জানান।

তিনি আরও জানান, আর্কা ফ্যাশন উইকে যে পোশাক ডিজাইন করেছেন, সেখানে একমাত্র রুনা খানের পরা পোশাকটি ছাড়া বাকিদের পোশাক ওয়ারেবল। অর্থাৎ নিয়মিত ব্যবহার উপযোগী।

ডিজাইনে কেন তিনি এত বেশি ফেব্রিকের ওপর জোর দেন? তানহা বলেন, ‘আমার আসলে  ফেব্রিক খুব ভালো লাগে। ফেব্রিক ম্যানিপুলেশন করে কীভাবে ডিজাইন করা  যায় সেটির দিকে আমার নজর থাকে বেশি। এই যেমন আর্কাতেও দেশি ফেব্রিক যেমন বলাকা সিল্ক, হাফ সিল্ক- এগুলো দিয়ে কাজ করেছি। এবার কিন্তু আমি রুশিং দিয়ে কাজ করেছি। যেহেতু কসমিক কানেকশন আমার এবারের ডিজাইনে গুরুত্ব পেয়েছে, সেক্ষেত্রে রঙের ক্ষেত্রেও বিষয়টি মাথায় রেখেছি। যেমন ধরুন, আমরা যখন নীহারিকার ছবি দেখি, সেখানে স্পেস ব্লু, কসমিক ব্লু- এই রঙগুলো দেখি, সেখান থেকে এপ্রিকট অরেঞ্জ- এই রঙগুলো নিয়েছি।

পোশাকে রুশিং টেকনিকে এমবেলিশমেন্ট করা হয়েছে

ফ্রেন্স ফ্যাশন ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান ডিওর তানহার পছন্দের ডিজাইনার। তার করা ডিজাইন অনুসরণ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ডিওর’র কালেকশন খুব ভালো লাগে। উনার বিষয়ে আমি পড়াশুনা করেছি। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে ধস নামে। উনি তখন প্রথম যে কালেকশন বের করেন সেখানে একটি পোশাক ছিল, নাম ‘বার জ্যাকেট।’ এই পোশাকের বৈশিষ্ট্য ছিল সাধারণ পোশাকের হিপের জায়গা থেকে একটু ফুলিয়ে, নতুন একটি ডমিন্যান্ট লুক বের করা। আমি হিপ এনহেন্সমেন্ট যেটা করেছি, সেটি ঐখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে। এই সময়ে পোশাকের এই ডিজাইন খুবই ট্রেন্ডি। এটা ফেমিনিন ও বোল্ড, ঐ জায়গা থেকে চিন্তা করা।’

রুনা খানের আউটফিট নিয়ে বিশেষভাবে বলেন তানহা। তিনি বলেন, ‘যেটি ভীষণভাবে ভাইরাল হয়েছে সেটি হচ্ছে, রুনা আপুর আউটফিটের ‘পিকাবু ব্রা’ স্টাইল। ২০২২-২০২৩ সাল থেকে এটি ট্রেন্ডি হয়ে উঠেছে। এই যে ব্রেসিয়ারকে টাইট করে পরতে হবে এই ধারণা থেকে কিন্তু এখন মেয়েরা বের হচ্ছে, বরং এখন মেয়েরা এটিকে উদযাপন করছে, ফ্যাশন হিসেবে নিয়েছে। মূলত এটি একটি বোল্ড স্টেটমেন্ট দেয়।’

বিমূর্ত চিত্র ও মহাকাশ থেকে নেওয়া হয়েছে অনুপ্রেরণাএরপর তিনি বলেন, ‘রুনা আপু সবসময় শ্রোতের বিপরীতে হাঁটতে পছন্দ করেন। একটু বোল্ড থাকতে দেখা যায় তাকে। উনিও বললেন, তান, চলো নতুন আর ভিন্নধর্মী কিছু করি। আমিও সেটাই চেয়েছি সমসময়। আমারও  মনে হয়েছে এখন এক্সপেরিমেন্ট না করলে আর কখন করবো। সবকিছু মিলিয়েই আসলে রুনা আপুর পোশাকের ডিজাইন করা। আমি মূলত আইকনিক ও মর্ডান পোশাকের সমন্বিত রূপ ডিজাইনে আনতে চেয়েছিলাম এবং সেটাই করেছি।’

অ্যাবস্ট্রাক্ট প্যাটার্ন ফুটে উঠেছে ডিজাইনে

প্রশংসার বিপরীতে থাকে সবসময় কিছু সমালোচনা। তানহার করা ডিজাইন নিয়ে অনেকে যেমন তাকে প্রসংশায় ভাসাচ্ছেন, অনেকে আবার সমালোচনা করতেও ছাড়ছেন না। কিন্তু এসব সমালোচনাকে পাত্তা দিতে চান না এই তরুণ ডিজাইনার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে বলেছেন, এই পোশাকটি বাংলাদেশের কালচারকে উপস্থাপন করে না। আসলে বাংলাদেশি কালচার কোনটি? কালচারের কথা যদি আমরা বলি, কলোনাইজেশনের শুরু থেকেই কিন্তু আমরা পরিবর্তনটাকে গ্রহণ করে নিয়েছি। যখন যারা আমাদের শাসন করেছে তাদের সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে। আমরা সবই গ্রহণ করছি সময়ের পরিক্রমায়। তাই কীভাবে আমরা বলি যে, এই পোশাকের ডিজাইন আমাদের কালচারেরর সাথে যায় না!’

তিনি আরও বলেন, ‘দেখুন আমাদের সংস্কৃতিকে যদি শুধু মিউজিয়ামেই আটকে  রাখি, তাহলে কিন্তু হবে না। বিশ্বে জানান দিত হবে। তবেই না আমাদের সংস্কৃতি, আধুনিকতা সম্পর্কে বিশ্ববাসী ধারণা পাবে।’

রুনা খান ও তানহা শেখ

বাংলাদেশে পোশাক নিয়ে বিশেষ করে আধুনিক পোশাক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ কতটুকু? এই প্রশ্নের উত্তরে তানহা বলেন, ‘আমার মনে হয় এখানে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আমি যদি আর্কা ফ্যাশন উইকের কথাই বলি, আর্কার সাথে যখন আমার কাজের কথা হয়, প্রথমেই সেখান থেকে আমাকে বলা হয়েছে, ‘প্লিজ, ব্রেক দ্য বাউন্ডারি, গো বিয়ন্ড।’

তানহা শেখ

আধুনিক সময়ের সাথে তাল মেলাতে হলে ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে হবে, এটাই মনে করেন তানহা। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে আমি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত  হয়েছি। সেই এক কাট, ডিজাইন, ফ্যাশন! বিশ্বের ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এই ফ্যাশন বা ডিজাইন দিয়ে সামনে এগোনো যাবে না। এক্ষেত্রে  আর্কাকে আমার পারফেক্ট একটি প্ল্যাটফর্ম মনে হয়েছে যারা নতুনত্বকে প্রাধান্য দেয়। দেখুন শাড়ি পরবো আমরা, কিন্তু তার বহুল ব্যবহার আমরা কেন করতে পারবো না? যেমন ধরুন, জামদানি বা বেনারসি শাড়ি। এই শাড়িকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্নে কেন বানাচ্ছি না বা বানালেই সেটি নিয়ে কথা বলার কী আছে!’

তানহা শেখ

মূলত দেশীয় ফেব্রিক নিয়ে কাজ করতেই বেশি পছন্দ করেন এই তরুণ ডিজাইনার। তানহা বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের নিজস্ব যে কাপড় সেটাতেই জোর দেই। আমাদের দেশীয় ফেব্রিকের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। ভারত, চায়না বা অন্য দেশ থেকে ফেব্রিক বা সুতা নিয়ে এসে কাজ করতে হয়। আগে যারা তাঁতি ছিলেন, তারা তাদের পেশা পরিবর্তন করেছেন। কারণ তাদের পেট চলে না এই পেশায়। অনেকে কাজ করলেও বাংলাদেশি ফেব্রিককে আমরা দাঁড় করাতে পারিনি। ঐ জায়গা থেকেই আমি ফ্রেবিকের উপর জোর দিয়েছি।’

তানহা শেখ

সব মিলিয়ে তানহা পোশাক নিয়ে চমৎকার এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। তার অ্যাস্ট্রিয়া কালেকশন সবার নজর কেড়েছে, সেই সাথে দিয়েছে স্রোতের বিপরীতে হাঁটার অনুপ্রেরণা।