• ৩০শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভারত-পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা: কতটা বাস্তব?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত মে ১৫, ২০২৫, ১২:০১ অপরাহ্ণ
ভারত-পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা: কতটা বাস্তব?
সংবাদটি শেয়ার করুন....

দক্ষিণ এশিয়ায় ফের উত্তেজনার আগুন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সর্বশেষ সংঘর্ষে কোনো চূড়ান্ত ‘আল্টিমেটাম’ ছিল না, ছিল না কোনো সরাসরি ‘লাল বোতাম’ টিপে থামিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। তবুও দুই দেশের মধ্যে সামরিক প্রতিক্রিয়া, নেপথ্য যোগাযোগ এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ দ্রুত একটি সম্ভাব্য বিপর্যয় ঠেকিয়ে দিয়েছে।

যদিও সর্বশেষ সংঘর্ষটি পারমাণবিক সংঘাতে রূপ নেয়নি, তবে এটি আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে ভারত-পাকিস্তান সংকট কত দ্রুত বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে পারে। বিজ্ঞানীরাও এই আশঙ্কা ব্যাখ্যা করেছেন ২০১৯ সালের একটি গবেষণার মাধ্যমে। সেই গবেষণায় একটি কাল্পনিক ২০২৫ সালের পরিস্থিতি দেখানো হয় যেখানে ভারতীয় সংসদে হামলার প্রতিক্রিয়ায় পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়। ২০২৫ সালে এসে বাস্তবেও এমন পূর্ণাঙ্গ সংঘাতের আশঙ্কা সামনে চলে এসেছে।

সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা কতটা ভঙ্গুর, সেটিই যেন নতুন করে প্রকাশ পেয়েছে। সংঘর্ষের সময় পাকিস্তান একদিকে সামরিক প্রস্তুতি নিলেও, অন্যদিকে ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির (এনসিএ) বৈঠক ডেকে পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতির বার্তা দিয়েছে। এনসিএ নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রাগার এবং সম্ভাব্য ব্যবহারের সিদ্ধান্ত।

এটা প্রতীকী বার্তা ছিল, না কি বাস্তব সতর্কতা – সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তার প্রশাসন শুধু যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাই করেনি, বরং পারমাণবিক সংঘাত ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তখন জাতির উদ্দেশে ভাষণে সাফ জানিয়ে দেন – পরমাণু ব্ল্যাকমেইল ভারত সহ্য করবে না, এবং ভারতের বিরুদ্ধে হুমকি দিলে তার কার্যকর জবাব দেওয়া হবে।

অস্ত্রের মজুত ও সক্ষমতা

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারত ও পাকিস্তানের হাতে রয়েছে গড়ে ১৭০টি করে পারমাণবিক অস্ত্র। বৈশ্বিকভাবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১২,১২১টি, যার মধ্যে ৯,৫৮৫টি রয়েছে সামরিক ভাণ্ডারে এবং প্রায় ৩,৯০৪টি অস্ত্র সক্রিয়ভাবে মোতায়েন করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার ক্ল্যারির মতে, ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের বড় অংশ ভূমি-ভিত্তিক মিসাইল সিস্টেমে মোতায়েন। উভয় দেশই ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়াড’ গঠনের পথে, তবে ভারত এ ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে। ভারতের নৌ-বাহিনী ও পরমাণু সাবমেরিন প্রযুক্তি পাকিস্তানের তুলনায় উন্নত বলে মনে করা হয়।

পারমাণবিক নীতি ও সংকেত

ভারত ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পর ‘নো ফার্স্ট ইউজ’ নীতি গ্রহণ করে, যদিও পরবর্তীতে ২০০৩ সালে রাসায়নিক বা জীবাণু হামলার প্রতিক্রিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নীতিও যুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই নীতিতে নমনীয়তা আনার ইঙ্গিত দেন, যা নীতিগত স্থিরতায় প্রশ্ন তোলে।

পাকিস্তান কখনোই আনুষ্ঠানিক পারমাণবিক নীতি ঘোষণা করেনি। তবে বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের বিবৃতি ও ঘটনার বিশ্লেষণে কিছু নির্দেশনা পাওয়া যায়। ২০০১ সালে খালিদ কিদওয়াই চারটি ‘রেড লাইন’ নির্ধারণ করেছিলেন – ব্যাপক অঞ্চলগত ক্ষতি, প্রধান সামরিক স্থাপনা ধ্বংস, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। ২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট মুশাররফ বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র কেবল ভারতকে ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই।

২০১৯ সালের সংঘাতের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দাবি করেন, পাকিস্তান পারমাণবিক প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন আশঙ্কায় ভারতীয় এক কর্মকর্তা তাকে মাঝরাতে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তবে বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি ছিল অতিরঞ্জন।

দুর্ঘটনার আশঙ্কা ও মানবিক ভুল

বিশেষজ্ঞ অ্যালান রোবকের মতে, পারমাণবিক উত্তেজনা শুধু কৌশলগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না – মানবিক ভুল, সাইবার হামলা, প্রযুক্তিগত ত্রুটি এমনকি নেতাদের মানসিক অস্থিরতাও বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

২০১৯ সালের আলোচিত গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, একটি ভারত-পাকিস্তান পারমাণবিক সংঘাত শুধু আঞ্চলিক নয়, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

২০২২ সালের মার্চে ভারতের একটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দুর্ঘটনাবশত পাকিস্তানে আছড়ে পড়ে। এতে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকিস্তানের অভিযোগ ছিল, ভারত প্রথমে হটলাইন ব্যবহার কিংবা প্রকাশ্যে দুঃখপ্রকাশ করতেও বিলম্ব করে। পরবর্তীতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর তিন কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

যদিও বর্তমানে একটি পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দেন যে ‘ইউজ ইট অর লুজ ইট’ পরিস্থিতি – অর্থাৎ বিপদে পড়ে অস্ত্র ব্যবহারের তাড়না – যে কোনো সময় সামনে আসতে পারে।

স্ট্যানফোর্ডের হুভার ইনস্টিটিউশনের ফেলো সুমিত গাঙ্গুলির মতে, কেউই প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে বিশ্বমঞ্চে কলঙ্কিত হতে চায় না, কারণ প্রতিশোধে যে ধ্বংস আসবে তা কেউই মেনে নিতে পারবে না।

তবুও উভয় দেশের অস্ত্রাগার সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস অনুসারে, পাকিস্তানের অস্ত্র সংখ্যা ২০০ ছাড়াতে পারে। ভারতের প্লুটোনিয়াম মজুত থেকেও ১৩০-২১০টি ওয়ারহেড তৈরি করা সম্ভব।

ইসলামাবাদভিত্তিক বিশ্লেষক উমর ফারুক বলেন, এখনও পর্যন্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজ করছে। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতি এমন এক স্থায়ী ঝুঁকি তৈরি করে, যা কোনোভাবেই পুরোপুরি উপেক্ষা করা যায় না।

সেন্টার ফর আর্মস কন্ট্রোল অ্যান্ড নন-প্রলিফারেশনের জ্যেষ্ঠ নীতি পরিচালক জন এরাথ বলেন, যতক্ষণ পারমাণবিক অস্ত্র আছে, ততক্ষণ বিপদের আশঙ্কাও থেকে যাবে। আর এই সামান্য ঝুঁকিই হয়ে উঠতে পারে একদিন ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ।

সুত্র: বি বি সি