২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় কেউ কল্পনাও করেননি যে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এমন সংকটপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছাবে। এই সরকার গঠনের পেছনে ছিল সশস্ত্র বাহিনী, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নেতৃত্ব এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন। সাধারণ মানুষেরও সেই সময় ব্যাপক সমর্থন ছিল, যারা চেয়েছিল স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী একটি সরকার।
প্রথমদিকে সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রচেষ্টা থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বোঝাপড়ায় ফাটল ধরে। সাম্প্রতিক সময়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্যেই প্রকাশ পায়, সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বেড়েছে, কারণ অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাদের অজ্ঞাতে।
একাধিক উপদেষ্টার পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার কিছু বক্তব্য, রাজনীতিতে দীর্ঘদিন নিপীড়িত নেতাদের ক্ষুব্ধ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যেমন চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া বা মিয়ানমারে ত্রাণ পাঠানোর প্রক্রিয়া।
বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণে বিলম্ব করায় সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আদালতের রায়ের পরও শপথ কার্যকর না হওয়াকে তারা উদ্দেশ্যমূলক দেরি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
নগরবাসীর ভোগান্তি সত্ত্বেও চার দিন ধরে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ না পেয়ে বিএনপি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অবস্থান জানায় এবং দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। তাদের মতে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে (ডিসেম্বরের মধ্যে) নির্বাচন না হলে সরকারের প্রতি সমর্থন রাখা কঠিন হবে।
অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টিও নির্বাচন কমিশনের কাঠামো ও কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং কিছু উপদেষ্টার দলীয় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে তাদের অপসারণ দাবি করে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন কোনো নির্বাচন পরিচালনা করেনি, এমনকি সীমানা নির্ধারণের কাজও সম্পূর্ণ হয়নি। ফলে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
ইশরাক ইস্যুতে আদালতের রায়ের পরও ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে বিএনপি সরকার ও এনসিপি—দু’পক্ষের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়। এ অবস্থায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তীব্র হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, বর্তমান রাজনৈতিক উত্তেজনা ও চাপের মধ্যে তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
তার পদত্যাগের গুঞ্জন উঠলে এনসিপি নেতারা ও তার ঘনিষ্ঠ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব অনুরোধ জানান, তিনি যেন এই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকেন।
আমরা মনে করি, এ মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়। বরং সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অবিলম্বে সংলাপে বসে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে হবে। যদি কোনো উপদেষ্টা দলীয় রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার ইচ্ছা রাখেন, তবে তাদের উচিত হবে পদত্যাগ করা, যাতে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে।
রাজনীতিতে যেভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে কটূক্তি ও বিদ্বেষমূলক ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। অতীতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ব্যবহার থাকলেও বর্তমানে যা হচ্ছে তা সরাসরি জনতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের মতো, যা ভয়াবহ প্রবণতা।
গণতন্ত্রের ধারায় ফিরতে হলে ‘মবতন্ত্র’ ও প্রতিষ্ঠানকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। নির্বাচন কবে হবে—জুন না ডিসেম্বর—এই বিতর্ক নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে একটি সম্মত রোডম্যাপই পারে দেশের অস্থিরতা দূর করতে।