আওয়ামী আমলে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে ঋণের নামে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। এ টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আদায় হচ্ছে না বলে এ অর্থ এখন খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে। ওই সময় সরকারের নীতিনির্ধারক ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা প্রভাব খাটিয়ে এসব অপকর্ম করেছেন। শুধুমাত্র একটি ব্যাংকের মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ খেলাপি। ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও তার বন্ধুবান্ধব মিলে সব টাকা নিয়ে চলে গেছেন।
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) সরকারের এক বছর পূর্তিতে দেশের সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতির ওপর সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মালটিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনিটি অনুষ্ঠিত হয়।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, নতুন আরও ১০১ জন অর্থ পাচারকারী শনাক্ত হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা করে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা ও পাচারের অর্থ ফেরত আনার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। এর আগে একজন ব্যক্তি একাই কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে-এমন ১১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছিল; যাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার মামলা করেছে।
আগামী চ্যালেঞ্জ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা দূর করতে পারিনি। সেখানে কর্মরত মানুষগুলো ঠিক করতে পারিনি। এ কাজটি শুরু করেছি। এটি অব্যাহত রাখা বড় চ্যালেঞ্জ আগামীতে নির্বাচিত সরকারের জন্য।
দেশের সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ এক বছরে অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে। কিছুটা দ্বিমত থাকতে পারে আপনাদের। তবে সুশাসনের ঘাটতি, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির কারণে আর্থিক খাত খাদের কিনারায় পড়েছিল। সেখান থেকে এখন একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে সব সূচক ছিল নেগেটিভ, এখন সব পজিটিভ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আইএমএফের শর্ত পালনে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপরে ছেড়ে দিয়ে আমরা ভুল করিনি। যদিও শুরুতে শঙ্কায় ছিলাম।’ মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করে উপদেষ্টা বলেন, জুনে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে আসবে। বর্তমান ৮ শতাংশের উপরে আছে। আর জুলাইতে ১৪ শতাংশে বিরাজ করছে।
ব্যাংক খাত প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেছেন, ‘ব্যাংকের লুটপাটের টাকা আপনার, আমার ও ঋণের টাকা। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যায় আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন করতে বলেছি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অর্থের প্রয়োজন হবে তা দেওয়া হবে।’
ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য চলতি বাজেটে কত টাকা বরাদ্দ রেখেছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা জানাতে অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য বরাদ্দ সেটি পর্যাপ্ত নয়। সেখানে আইএমএফও টাকা দেবে। ব্যাংকের আমানতকারীদের কারও অর্থ খেয়ানত হবে না এটি আমি নিশ্চিত করছি। এজন্য যা প্রয়োজন তা করা হবে।
ব্যাংকগুলো একীভূত করার প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, কতগুলো ব্যাংক একীভূত করা হবে সে তথ্য প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক সমন্বয় করা মানে আমাদের দেশের ভাষা হচ্ছে শেষ হয়ে গেল। যে কারণে এ তথ্য এখনই প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক করবে।
নির্বাচিত সরকার এসে ব্যাংক খাত সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে নাও পারে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কোনো ধরণের প্রতিশ্রুতি নেবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কিছু কিছু আলাপ হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাংক সংস্কার কার্যক্রম উলটে-পালটে দেয়, সেক্ষেত্রে আমানতকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে ওই ব্যাংক থেকে।
টাকা ফেরত আনার প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ইতোমধ্যে বড় ধরণের ১১টি কেস ফাইল করা হয়েছে। পাচারকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে। কোন কোন জায়গায় পাচার করেছে সেটি শনাক্ত হয়েছে। এখন এসব টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ১২টি দেশের সঙ্গে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট (এমএলএ) করতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। টাকা ফেরত আনতে আমরাও আইনজীবীর মাধ্যমে চেষ্টা করছি।
ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের রাজস্ব আহরণ খুব আশাতীত নয়। এমন পরিস্থিতিতে ঋণ না আনলে কিভাবে চলবে। এখানে করের হার বাড়ালেই আয় বেশি হবে তা নয়। কর আদায় নির্ভর করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতির ওপর। তবে ঋণ পরিশোধের সীমা ঠিক থাকে সে ব্যাপারে সতর্ক আছি। এতকিছুর পরও ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।