• ২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৮ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ম খা আলমগীরের পেটে পদ্মা ব্যাংক

মিলল আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশিত আগস্ট ১৮, ২০২৫, ১৫:৫২ অপরাহ্ণ
ম খা আলমগীরের পেটে পদ্মা ব্যাংক
সংবাদটি শেয়ার করুন....

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ওরফে মখা আলমগীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের বিস্ময়কর তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ।

ফারমার্স ব্যাংক নাম পরিবর্তন করে হয় পদ্মা ব্যাংক। সেই ব্যাংক লুটের প্রধান কারিগর ছিলেন মখা আলমগীর। চেয়ারম্যান থাকার সময় তার আমলে প্রায় ৩৩০০ কোটি টাকা লোপাট হয়। তার সহযোগী বাবুল চিশতির মাধ্যমে আরও প্রায় ১৭০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এভাবে পদ্মা ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৮৬ শতাংশ। বাবুল চিশতি শাস্তি পেলেও এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন মখা আলমগীর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় তার বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ তো দূরের কথা, ভয়ে কেউ মুখও খোলেনি।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) রিপোর্ট, পদ্মা ব্যাংকের নথি ও যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন মখা আলমগীর।

খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পদ্মা ব্যাংকের ওপর ফরেনসিক অডিট এখন অত্যন্ত জরুরি। তাহলেই ব্যাংকটির ভেতরে চলা লুটপাটের পুরো চিত্র বেরিয়ে আসবে।

সর্বশেষ তদন্তে দেখা গেছে, মখা আলমগীর, তার স্ত্রী সিতারা আলমগীর ও পরিবারের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোট ৩৯৮ কোটি ৯১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ২০০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জমা হলেও ১৯৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বর্তমানে অ্যাকাউন্টগুলোতে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ২ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আদালতের নির্দেশে এসব অ্যাকাউন্ট আবারও স্থগিত করা হয়েছে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ পাচার

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্ত্রী থাকাকালে মখা আলমগীর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে বিপুল অর্থ অর্জন করেন। সেই অর্থ বিদেশে পাচার এবং ভুয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। কখনো নিজের নামে, কখনো স্ত্রীর নামে আবার কখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এসব কার্যক্রমে পদ্মা ব্যাংক ছাড়াও আইএফআইসি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংক ব্যবহার করা হয়েছে।

ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেনদেন

তদন্তে উঠে এসেছে, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের জন্য একাধিক ভুয়া প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে শুভ অটোরাইস মিল, সুলতানা ফিলিং স্টেশন, মেসার্স সুলতানা অয়েল মিল, গুলবাহার হিমাগার লিমিটেড ও সুলতানা ফাউন্ডেশন। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন নিয়ে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা এবং আমানতকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করার প্রমাণ মিলেছে।

তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা

বিএফআইইউর প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মখা আলমগীর ও তার স্ত্রী মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২(শ)(১৯) ধারা লঙ্ঘন করে কর-সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে আরও তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে।

ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি

২০১৩ সালে ফারমার্স ব্যাংক অনুমোদন পায়। শুরু থেকেই অবৈধ নিয়োগ, নিয়মবহির্ভূত ঋণ বণ্টন ও অর্থ লোপাটে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটি। চেয়ারম্যান মখা আলমগীর এবং নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক বাবুল চিশতি ছিলেন এই কেলেঙ্কারির মূল হোতা। তারা শুধু অবৈধ ঋণ অনুমোদনই দেননি, গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে নিজেদের অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তরও করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটিকে ‘নৈতিকস্খলন’ বলে আখ্যায়িত করে।

গ্রাহকের টাকায় লুটপাট

ব্যাংকের লোপাটের কারণে গ্রাহকরা নিজেদের সঞ্চিত টাকা ফেরত পাননি। এমনকি সরকারের জলবায়ু তহবিলের অর্থও ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় ব্যাংকটি। পরিস্থিতি অবনতির মুখে ২০১৭ সালে মখা আলমগীরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে সরকারের হস্তক্ষেপে ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক রাখা হয়।

পদ্মা ব্যাংকে সরকারি মালিকানা

ব্যাংককে বাঁচাতে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংক ও আইসিবির হাতে প্রায় ৭০ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তর করা হয়। তারা ৭১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। ২০১৮ সালে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত চেয়ারম্যান হলে কিছুটা স্থিতিশীলতা এলেও পরে ফের অনিয়ম শুরু হয়। বর্তমানে সরাফাতও পদত্যাগ করে বিদেশে আছেন।

উল্লেখ্য, বাবুল চিশতি ও তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতিকে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে আদালত ১২ বছর কারাদণ্ড দেন।

পদ্মা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের এমডি শওকত আলী খান জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এখন অনাবশ্যক ব্যয় কমানো এবং খেলাপি ঋণ আদায় থেকে আমানতকারীদের কিছু অর্থ ফেরতের চেষ্টা চলছে। একটি স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।