যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ বিশ্ব রপ্তানি বাণিজ্যে বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এর প্রভাবে চীন এখন ক্রমেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাজারে রপ্তানির দিকে ঝুঁকছে। ফলে ২৭ জাতির এই জোটে চীনের পোশাক রপ্তানি দ্রুত বাড়ছে। উল্টো এই কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছে।
ইউরোস্ট্যাটের (ইইউর সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা) হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭ শতাংশ, যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫ শতাংশ। অথচ কয়েক মাস আগেও দুই দেশের প্রবৃদ্ধিতে এত ব্যবধান ছিল না। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়ে বাংলাদেশ ছিল এগিয়ে। গত বছরের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছিল ৩৭ শতাংশ। একই সময়ে চীনের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫ শতাংশ। আবার জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসের গড়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ, আর চীনের বেড়েছে ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ জুলাইয়ে হঠাৎ করেই চীন রপ্তানিতে চার গুণ বেশি প্রবৃদ্ধি দেখালেও সামগ্রিক গড়ে পার্থক্য তুলনামূলক কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই মাসে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ছিল ১৬৮ কোটি ডলারের কম, যেখানে চীনা পোশাকের রপ্তানি দাঁড়ায় ২৭৮ কোটি ডলারের বেশি। বছরের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে এক হাজার ১৯৭ কোটি ডলারের পোশাক, চীনের রপ্তানি সেখানে এক হাজার ৪০৬ কোটি ডলারের। এই সময়ে ইইউর মোট পোশাক আমদানি বেড়েছে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৯২ কোটি ডলারে।
এই পরিস্থিতির পেছনে মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ‘পাল্টা শুল্ক’। চলতি বছরের ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র সব দেশের পণ্যে ১০ শতাংশ এবং বাংলাদেশসহ ৬৫ দেশের পণ্যে বিভিন্ন হারে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। বিশেষ করে চীনা পণ্যে দফায় দফায় ঘোষণায় ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের কথা শোনা যায়। পরে সেই হার কিছুটা কমলেও ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে বলে ধারণা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বাজার সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং দেশটি বিকল্প হিসেবে ইইউতে রপ্তানি বাড়াতে থাকে।
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় চীন ও ভিয়েতনাম অন্যত্র রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এতে ইইউ বাজারে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই দাম কমানোর চাপ দিচ্ছে, যা প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও ডেনিম এক্সপার্টের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে উচ্চ শুল্ক বসিয়েছে, সেটা বাংলাদেশের তুলনায় কয়েক গুণ। তাই চীনের জন্য ইইউ এখন সবচেয়ে বড় বিকল্প বাজার। তারা আগে থেকেই নিজস্ব কাঁচামাল, কম লিড টাইম আর উচ্চ উৎপাদনশীলতার কারণে এগিয়ে আছে। আমাদের এখন একমাত্র ভরসা—ইইউতে শুল্কমুক্ত সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার।’
বর্তমানে ইইউর বাজারে শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় চীন প্রথম, বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে। তুরস্ক তৃতীয়, ভারত চতুর্থ ও কম্বোডিয়া পঞ্চম। ভিয়েতনাম ষষ্ঠ, পাকিস্তান সপ্তম, মরক্কো অষ্টম, শ্রীলঙ্কা নবম এবং ইন্দোনেশিয়া দশম।
সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি বৈশ্বিক রপ্তানি ভারসাম্য পাল্টে দিয়েছে। এর সুযোগ নিচ্ছে চীন, আর বাংলাদেশকে বাড়তি প্রতিযোগিতা মোকাবিলায় কৌশলগতভাবে ইইউ বাজারে আরও মনোযোগী হতে হবে।