ভারতীয় পোশাক ও বুনন শিল্পে মুসলিমদের অনেক বড় অবদান ছিল। মুসলমানদের আগমনের আগে বেশির ভাগ ভারতীয় মোটা সুতা ও অপরিশোধিত পশমের পোশাক পরিধান করত। গুজরাটের শাসক সুলতান মাহমুদ বিন মুহাম্মদ গুজরাটি (৯১৮ হি.), যিনি মাহমুদ বিকরাহ নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি বহু শিল্পের সূচনা করেন। তার হাতে তাঁত, বুটিক, সেলাই, নকশা ও কাটার কাজের বিকাশ ঘটে।
এ ছাড়া তার সময়ে হাতির দাঁত, রেশমি কাপড় ও কাগজশিল্পের উন্নতি সাধন হয়। সুলতান মাহমুদ ছিলেন একজন বড় শিল্পসাধক ও শিল্পানুরাগী শাসক। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিতে বিপ্লব সাধিত হয়, যা সমকালীন আর কোনো শাসকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ভারতীয় ইতিহাসবিদ আল্লামা সাইয়েদ আবদুল হাই হাসানি (রহ.) লেখেন, ‘তার অন্যতম অবদান হলো সমাজ ও দেশ নির্মাণ, মসজিদ-মাদরাসা ও খানকা স্থাপন, কৃষি সম্প্রসারণ, ফলদ বৃক্ষ রোপণ, ফুল-ফলের বাগান সৃষ্টি এবং মানুষকে তাতে উদ্বুদ্ধ করা; তাদেরকে কূপ ও খাল খননে সহযোগিতা করা।’
এ জন্য তার রাজ্যে মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন অনারব অঞ্চল থেকে কারিগর, শিল্পী, নির্মাতা ও পেশাজীবীরা সেখানে আগমন করে এবং নিজ নিজ পেশা ও শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখে। তার শাসনামলে কূপ, পানির নালা, হাউস, ফল-ফুলের বাগান, শস্যক্ষেতের সমারোহে গুজরাট সবুজের স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়। তখন গুজরাট রূপ নেয় একটি বাণিজ্য নগরীতে।
মুসলিম-পূর্ব ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসব ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পাওয়া যায় না। বাদশাহ শের শাহ সুরি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক ও প্রতিভাবান প্রশাসক। উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে তিনি অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। সম্রাট আকবরও ছিলেন তার অনুগামী। একইভাবে ভারতে পশু পালন, পশু সংগ্রহ, জাত উন্নয়ন এবং পশুর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইসলামী শাসনের বিশেষ অবদান রয়েছে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ‘তুজুকে জাহাঙ্গীরী’ ও ‘আইনে আকবারি’তে যার বর্ণনা পাওয়া যায়।
হাসপাতাল, সেবাকেন্দ্র, গণ-উদ্যান, বিনোদনকেন্দ্র, দীর্ঘ খাল ও বড় পুকুর ছিল ইসলাম শাসনের অনুগ্রহ, যা ভারতে আগে কখনো দেখা যায়নি। আল্লামা আবদুল হাই হাসানি (রহ.) ‘জান্নাতুল মাশরিক’ গ্রন্থে ইসলামী শাসনাকালে নির্মিত হাসপাতাল, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান ও মহাসড়কগুলোর দীর্ঘ তালিকা প্রদান করেছেন। মুসলিম শাসনামলেই এমন দীর্ঘ সড়ক নির্মিত হয়েছিল, যা ভারতের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
একটি উদাহরণ হলো গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড, যা নির্মাণ করেছিলেন শের শাহ সুরি। এই রাস্তা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সোনারগাঁও থেকে এবং শেষ হয়েছে পাকিস্তানের সিন্দু প্রদেশের ‘মায়ে নাইলাব’ এলাকায়। রাস্তার দৈর্ঘ্য চার হাজার ৮৩২ কিলোমিটার। প্রত্যেক তিন মাইল পর পর স্থাপন করা হয় বিশ্রামাগার বা পথিক নিবাস, যেখানে হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য পৃথক খাবারের ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেক তিন কিলোমিটার পর পর একটি মসজিদ ছিল, যেখানে মুয়াজ্জিন, ধর্মীয় শিক্ষক ও ইমাম নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। প্রতিটি বিশ্রামাগারে দুজন ঘোড়সওয়ার ডাকবাহক থাকতেন।
মুসলিমরা বহির্বিশ্ব থেকে ভারতে যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিল, তা হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থাপনার নতুন ধারার প্রবর্তন। মুসলিমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূলনীতি, ঘরকে আলো-বাতাসে পূর্ণ রাখার কৌশল এবং আসবাবপত্রের পরিচ্ছন্নতা শেখায়।
স্থাপত্যশিল্পেও মুসলিমরা নতুন যুগের সূচনা করে—যা মৌলিকত্ব, সূক্ষ্মতা, সৌন্দর্য, উপযোগিতা, উৎকর্ষ এবং আলো-বাতাসের সরবরাহের বিচারে বিশেষ মর্যাদাশীল। তাজমহল মুসলিম যুগের স্থাপত্যশিল্পের স্মৃতিবহন করে, যা সূক্ষ্ম শিল্পবোধ ও সৃজনশীলতার প্রতীক। জওহারলাল নেহরু স্বীকার করেছেন যে ভারতবর্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে মুসলমানদের গভীর প্রভাব রয়েছে।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা পাট্টাভি সীতারামায়া বলেন, ‘মুসলিমরা আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে, প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেছে, বিভক্ত ভারতকে একতাবদ্ধ করেছে এবং দেশের সাহিত্য ও সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে।’
ড. হান্টার বলেন, ‘মুসলিমরা দক্ষিণ ভারতে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে অঞ্চলকে জীবন দেয়। পর্যটকরা দ্রুত চোখে পড়ে স্থানীয় বড় পুকুর, চাষাবাদ, মসজিদ, দুর্গ, ভবন, কূপ ও পানির হাউসগুলো।’