বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) উত্তরা-তুরাগ ঢাকা মেট্রো-৩ সার্কেল অফিসে ঘুষ, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
মঙ্গলবার ও আজ বুধবার সকালে (৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) ইং তথ্য অনুসন্ধান, সরজমিন পরিদর্শন, ভুক্তভোগী ও বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে আলাপকালে দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের
এসব চিত্র দেখা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অভিযোগে জানা গেছে, উত্তরা বিআরটিএ অফিসে ঘুষ বানিজ্য এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। এ সরকারি অফিসকে ঘিরে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী, বহিরাগত ও মৌসুমি দালাল চক্রের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। আর নামি-দামি মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার (গাড়িতে) ঘুরে বেড়ায় দালাল চক্রের সদস্যরা। উত্তরার বিআরটিএ অফিসকে কেন্দ্র করে রয়েছে দালাল ও প্রতারক চক্রের বিশাল সিন্ডিকেট। ২০১৫ সালের জুনে ভাড়া ৩/৪ তলা বিশিষ্ট বাড়িতে উত্তরা বিআরটিএ অফিসের কার্যক্রম শুরু করা হয়। ওই অফিসের পাশে নতুন করে আরও একটি সাড়ে ৬ তলা ভবন রয়েছে। সেখানে একটি ডিজিটাল সাইনবোর্ড লাগানো আছে। সাইনবোর্ড লিখা আছে বিআরটিএ উত্তরা। বর্তমানে দুই অফিসেই চলছে কার্যক্রম। এছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স কিংবা গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক করতে অফিসে এসে অনেকেই দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যদের হাতে অহেতুক হয়রানির শিকারে পড়তে হচ্ছে সেবা প্রত্যাশী গ্রাহকরা। অনেক ক্ষেত্রে তারা দালাল কিংবা অফিস স্টাফদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। কোন কোন সময় কাগজ পত্র জমা ও হাতে পেতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে আর নিচে নামতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বিভিন্ন ভাবে হতে হয় নাজেহাল। কোন কোন সময় উভয়ের মধ্যে ভুলবোঝাবুঝি থেকে হাতাহাতির ঘটনাও অহরহ ঘটছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্র ও একাধিক নির্ভরযোগ্য তথ্য সূত্রের।
একটি নির্ভরযোগ্য সুত্র জানায়, বিআরটিএ উত্তরা-তুরাগ ঢাকা মেট্রো-৩ সার্কেল অফিসে ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেয়ার নামে অত্যন্ত সু- কৌশলে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের পকেটভারী করছে। ইতিপূর্বে যারা এ কাজ গুলোর সাথে জড়িত ছিল তারা অনেকটাই লাপাত্তা হয়ে গেছে। বিআরটিএ অফিসের কতিপয় কিছু কর্মকর্তা একাধিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাজার হাজার কিংবা লাখ লাখ টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিচেছন বলে অভিযোগ উঠেছে । বিআরটিএ অফিসে আসা একাধিক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদকের কাছে এ ধরনের অভিযোগ তুলে ধরেন।
এদিকে, ঢাকা মেট্রো-৩ সার্কেল উত্তরা বিআরটি অফিসে উত্তরা, তুরাগ ও উত্তরখান এলাকা থেকে মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইন্সেস করতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ভুক্তভোগী গ্রাহক জানান, এখানে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ হয়না এবং ফাইল ও নড়ে না। অফিসের আশপাশে গড়ে উঠেছে কম্পিউটার, নোটারী সহ বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট। দামি দামি ও স্হানীয় কতিপয় দালাল এবং মৌসুমি দালালদের টাকা দিলে ফাইল নড়ে; আর টাকা না দিয়ে কোন ফাইল নড়ে না। কাজও হয়না। দিনের পর দিন ফাইল অফিসে পড়ে থাকে। বিআরটিএ অফিসের ইটেও বলে টাকা চাই? টাকা দে! গত বছর ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের আগে বিআরটিএ অফিসকে ঘিরে দালাল চক্রের উৎপাত ছিল চোখে পরার মতো। কিন্তু বর্তমানে তার সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কমে গেছে। তবে, কিছু প্রভাবশালী দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিআরটিএ অফিসের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব মুখ চেনা ও মুখোশধারী দালালরা শিকারের আশায় অফিস স্টাফ কিংবা অফিসারদের পাশেই দাঁড়িয়ে কিংবা বিভিন্ন দোকান পাটে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অফিসে প্রথম শ্রেণির দায়িত্ব প্রাপ্ত একজন ম্যাজিষ্ট্রেট আছে। মাঝে মধ্যে তার নেতৃত্বে দাদাল ধরতে অভিযান চালানো হয়। এছাড়া এলিট ফোর্স র্যাব-১ কর্তৃক মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত)ও পরিচালনা করা হয়। ইতিপূর্বে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের অসংখ্য সদস্যকে আটক করে জেল হাজতে পাঠিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের মধ্যে অনেককেই জরিমানা ও শাস্তি দেয়া হয়েছিল। অনেক দালাল জেল খেটে জামিন নিয়ে এসে ফের আগের পেশায় ফিরেছে। অনেকেই বিপুল টাকা, বিষয় সম্পত্তি, গাড়ি বাড়ির মালিক বনে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ আছে জেল খানায়; আবার কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে বলে ও অভিযোগ রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র গুলো বলছে, অফিসের সামনে সরকারি জমির ওপর ব্যাঙ্গের ছাতার মতো অবৈধ পন্থায় গড়ে উঠেছে খাবার হোটেল, কম্পিউটারের দোকান, ফটোকপির দোকান, চা- পানের দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান । ওই সব প্রতিষ্ঠান গুলো হলো দালাল সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যদের আড্ডা খানায় পরিনত হয়েছে । স্হানীয় প্রভাবশালী জনৈক কতিপয় ব্যক্তি ও সরকার দলীয় পরিচয়ে কিছু পাতি নেতারা এর সাথে জড়িত আছে । এসব অবৈধ দোকানপাট ও স্হাপনা গুলো থেকে একটি চক্র দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে টাকা নেয়। তবে, ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকরা এবিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। সম্প্রতি জাতীয় একাধিক দৈনিক পত্রিকা ও বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে তুরাগ- উত্তরায় সরকারি পরিত্যক্ত জায়গা জবর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ দোকানপাট ও বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এবিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর গেল সপ্তাহে ডিয়াবাড়ি ও চন্ডাল ভোগ নতুন বাজার সোনারগাঁও জনপথ সড়কের পাশে অবৈধ দোকানপাট ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সকালে উচেছদ অভিযান চলালেও ঘটনার দিন কিংবা তার পরের দিন আবার নতুন করে যার যার জায়গায় ব্যবসায়ীরা দোকানপাট
গড়ে তোলে। সিটি কর্পোরেশন এক দিকে ভাঙ্গে ; ব্যবসায়ীরা আরেক দিকে গড়ে। সমাজের সচেতন মহল ও সংশ্লিষ্টরা বলছে, উচেছদের নামে উত্তরা ও তুরাগে অনেকটাই চোর পুলিশ খেলা চলছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, কার হাত শক্ত ও ক্ষমতা বড়। সরকার প্রধানের নাকি অবৈধ দখলদার ও ব্যবসায়ীদের।
স্হানীয় ক্ষতিগ্রস্হ ব্যবসায়ী ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আমরা টাকা দিয়েই সরকারি জায়গায় দোকানপাট বসিয়েছি এবং ব্যবসা করছি। আগে ঝামেলা ছিল বেশি। টাকাও দিতাম বেশি। এখন ঝামেলা কম; তাই টাকার পরিমাণ ও দেই কম! স্হানীয় লোকজনকে ম্যানেজ করেই আমাদেরকে ব্যবসা করতে হয়। সম্প্রতি দোকানপাট উচেছদ ও ভাংচুর করার পর নিজেরাই টাকা খরচ করে ঘর উঠিয়ে নিয়েছি। আবার ভাঙ্গে আবার নতুন করে ঘর উঠবে। সমস্যাটা কি? বর্তমানে দেশে নির্বাচিত কোন সরকার নাই। যা পার কামাই কর!
সংশ্লিষ্ট ও সচেতন মহলের কেউ কেউ মনে করছেন; এভাবে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ সেবাপ্রদান কারী বিআরটিএ অফিস চলতে পারেনা। এখানে নিয়মের কোন বালাই নেই। নেই কোন নিয়মনীতিও। অফিসের ভেতরে ও বাহিরে নেই কোন সিষ্টেম। যে যার মত হাতে কাগজপত্র ও ফাইল নিয়ে এক রুম থেকে অন্য রুমে অবাধ চলাচল করছে। এছাড়া অফিসের সেবা দেখে মনে হচ্ছে – জোর যার মুল্লুক তার! যার ফলে প্রতিবছর সরকার এই খাত থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচেছ।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সপ্তাহের বৃহস্পতিবার উত্তরা বিআরটিএ অফিসে ঘুষের অবৈধ টাকা লেনদেন ও বন্টন করা হয়ে থাকে। সেকারণে বিআরটিএ অফিসে ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধের জন্য সরকারের কঠোর ভাবে নজর দেওয়া কিংবা জরুরি ভিত্তিতে তদারকি করা দরকার বলে ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সূত্র গুলো বলছে, রাজধানীর উত্তরা -তুরাগের দিয়াবাড়ি সোনারগাঁও জনপথ সড়কের উত্তর পাশে একটি ৩/৪ তলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে ২০১৫ সালের জুন মাসে বিআরটিএ’র তিন নম্বর জোনের কার্যক্রম শুরু করা হয়। কাগজপত্র সংগ্রহের পাশাপাশি এখানে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক চালক ও মালিক সনদ সংগ্রহসহ গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার জন্য ছুঁটে আসেন।
ডিয়াবাড়ি বিআরটিএ এলাকার কতিপয় স্হানীয় বাসিন্দারা এ প্রতিবেদককে জানান, বিআরটিএ উত্তরা-তুরাগ ঢাকা মেট্রো-৩ সার্কেল অফিসে আগের তুলনায় এখন দালাল নেই বললেই চলে। বর্তমানে দালাল মুক্ত বিআরটিএ অফিস।
এবিষয়ে জানতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো-৩ সার্কেল অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ইতিপূর্বে দালালের উৎপাত ছিল শুনেছি। বর্তমানে কোন দালাল নেই বললেই চলে। এবিষয়ে অভিযোগ পেলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্হা গ্রহন করা হবে হুশিয়ারি দেন তিনি।
এবিষয়ে তুরাগ- উত্তরার সর্বস্তরের মানুষ ও ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চেয়ে বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, পুলিশ প্রধান (আইজিপি), ডিএমপির পুলিশ কমিশনার, এলিট ফোর্স র্যাব ডিজি, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানসহ সরকারের সংশ্লিষ্ঠ বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।