চলতি বছর ৩০ হাজার টন ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সার আমদানিতে দরপত্রে অংশ নেয় বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। বিদ্যমান নীতিমালা ও আইনে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি টন সার আমদানিতে ব্যয় ধরেন ৭৯৫ ডলার। কিন্তু আইন ও নীতিমালা পরিবর্তনের মাধ্যমে সেই একই সার আমদানিতে এখন ব্যয় হচ্ছে ৬৮৮ ডলার। ফলে নীতিমালা পরিবর্তনের কারণে প্রতি টন টিএসপি সার আমদানিতে ব্যয় কমেছে ১০৭ ডলার বা প্রায় ১৩ হাজার টাকা। ফলে ৩০ হাজার টন সার আমদানিতে ব্যবসায়িদের মুনাফা কমেছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
২০ হাজার টন করে ডিএপি সার আমদানির প্রস্তাব দেয় নোয়াপাড়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও মৌনতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতি টন সার আমদানিতে ব্যয় দেখায় ৯৫১ ডলার। তবে নীতিমালা পরিবর্তনের কারণে এই দর নেমে আসে ৮৭৪ ডলারে। ফলে এই দুটি প্রতিষ্ঠানে প্রতি টন সার আমদানিতে বেশি দাম দেখিয়েছিল প্রায় ৭৭ ডলার বা প্রায় সাড়ে ৯ হাজার টাকা। ফলে ৪০ হাজার টন সার আমদানিতে দুটি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা কমেছে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড স্বত্বাধিকারী আমিনুর রশিদ খান মামুনের সঙ্গে। ব্যাংকক থেকে তিনি ইত্তেফাক ডিজিটালকে বলেন, সরকার সার আমদানিতে নীতিমালা পরিবর্তন করে ব্যবসায়ীদের মুনাফা কমিয়েছেন। এর ফলে সরকারের বড় ধরনের অর্থের সাশ্রয় হয়েছে। তবে দেশের সার আমদানিতে আরও বেশ কিছু নীতিমালা পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। আগে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও আমরা সার আমদানির অনুমতি পাইনি। এখন সর্বনিম্ন দরদাতার পরেও আরও দাম কমিয়ে দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। এতে সরকার লাভবান হচ্ছেন কিন্তু ব্যবসায়ীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রথম লটে ৫ লাখ ৫৫ হাজার টন সার আমদানিতে কৃষি মন্ত্রণালয় সাশ্রয় করেছে ১ কোটি ৯০ লাখ ৫৫ হাজার ডলার। ঐ সময়ের বিদ্যমান বিনিময় হারে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২৩৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। কার্যাদেশ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের আমদানীতব্য সারের প্রস্তাবিত দেশভিত্তিক দর এর সঙ্গে দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ও কার্যাদেশ প্রদত্ত দর এর মধ্যে উভয় দরের পার্থক্য যাচাই করে এই পার্থক্য নির্ধারণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে ৩ লাখ ৩৫ হাজার টন ডিএপি সার আমদানিতে সাশ্রয় হয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৫ হাজার ডলার। আলাদা আলাদা লটে ১০টি প্রতিষ্ঠান এসব সার আমদানি করবে। এর মধ্যে দুটি লটে ৮০ হাজার টন আমদানির দায়িত্ব পাবে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লি:। এছাড়া নোয়াপাড়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২০ হাজার টন, মৌনতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২০ হাজার টন, দেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন ৪০ হাজার টন, মোশারফ এন্ড ব্রাদার্স ৪০ হাজার টন, মেসার্স সুফলা ট্রেডিং কর্পোরেশন ২৫৫ হাজার টন, সাইফুল্লাহ গালফ ৩০ হাজার টন, নোয়াপাড়া ট্রেডিং ৪০ হাজার টন, এনআরকে হোল্ডিং ৪০ হাজার টন।
অন্যদিকে ৯০ হাজার টন এমওপি সার আমদানিতে সাশ্রয় হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এর মধ্যে ৬০ হাজার টন আনবে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লি: ও ৩০ হাজার টন আনবে দেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন। এছাড়া ৯০ হাজার টন টিএসপি আমদানিতে সাশ্রয় হয়েছে ৫ লাখ ২৮ হাজার ডলার। এর মধ্যে ৬০ হাজার টন সার আমদানি করবে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লি: ও ৩০ হাজার টন আমদানি করবে দেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন।
তালিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সর্বনিম্ন দরদাতাদের মধ্যেও গুটিকয়েক কোম্পানি সার আমদানির সুযোগ পাচ্ছে। ফলে সামনের দিনে এসব সার আমদানিতে কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে বলে জানাচ্ছে বিশ্লেষকরা।
এসব সার আমদানিতে সবচেয়ে বেশি পার্থক্য দেখা গেছে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডে। প্রতি টন টিএসপি সার আমদানিতে পার্থক্য দেখা গেছে ১০৭ ডলার। এরপর রয়েছে নোয়াপাড়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও মৌনতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। এই দুটি প্রতিষ্ঠানে বেশি দাম দেখিয়েছিল প্রায় ৭৭ ডলার। এছাড়া মোশারফ এন্ড ব্রাদার্স ও সাইফুল্লাহ গালফ প্রতি টন ডিএপি সার আমদানিতে বেশি দেখিয়েছিল ৫৫ ডলার।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে একেক দেশের একই সারের জন্য একাধিক দরদাতা ভিন্ন ভিন্ন দরে সরবরাহের সুযোগ পেত। এতে সরকারকে টনপ্রতি ২০-১৫০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত অতিরিক্ত গুনতে হতো। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শুধু সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। সাধারণত কয়েকজন মিলে সিন্ডিকেট করে একটি দরপ্রস্তাব করে কাজ ভাগাভাগি করে নিত। সেই সুযোগ আর রাখা হয় নি। এখন থেকে বাজারদর যাচাই করে সর্বনিম্ন হার নির্ধারণ করে দিচ্ছে সরকার। সেই দরের ওপর প্রস্তাব করে সার সংগ্রহ করতে হবে। এতে সরকারের বিপুল অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়া সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করলে ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকার ডিলার সিন্ডিকেট ভাঙতে ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯’ সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা, বিএডিসি-বিসিআইসি আলাদা ডিলার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া, ডিলারের সংখ্যা বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে নতুন নীতিমালায়। এতে শত শত কোটি টাকার সাশ্রয় হবে, ভর্তুকির চাপ কমবে এবং কৃষকরা সাশ্রয়ী দামে নিরবচ্ছিন্ন সার পাবেন বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিলাররা সবধরনের সার বিতরণের দায়িত্ব নিত না। কোনো ডিলার ইউরিয়া সার, কোনো ডিলার নন-ইউরিয়া সার। এতে কৃষককে পৃথক পৃথক স্থান থেকে সার সংগ্রহ করতে হতো। তবে এখন এই বিভাজনের সুরাহা করতে যাচ্ছে সরকার। ভবিষ্যতে এক জায়গায় সব ধরনের সার পাওয়া যাবে। বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) ও বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) ডিলাররা এখন থেকে ‘সার ডিলার’ হিসেবে বিবেচিত হবেন। পাশাপাশি যেসব ডিলার অনিয়মের মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তাদের লাইসেন্স বাতিলের কথাও ভাবছে সরকার।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান ইত্তেফাক ডিজিটালকে বলেন, চলতি অর্থ বছরে সার আমদানিতে বড় ধরনের অর্থের সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। আমরা সার আমদানিতে সব ধরনের সিন্ডিকেট ভাঙবো। সরকারের কোন ধরনের বাড়তি ব্যয় যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। সারের ভর্তুকির অর্থ সাশ্রয় করে প্রয়োজনে কৃষকের অন্য খাতে ব্যয় করা হবে, বিশেষ করে যান্ত্রিকীকরণ, দুর্যোগকালীন বিশেষ প্রণোদনা ও অন্যান্য উপকরণে। এজন্য সার বিষয়ক নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে সাধারণত প্রধান চারটি সার ব্যবহৃত হয়। এগুলো হলো—ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি (পটাশ)। ইউরিয়া সার আমদানি করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)। বাকি সার আমদানিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডি.সি) দায়ী। গত বছর প্রায় ৬৫ লাখ টন সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া, সাড়ে সাত লাখ টন টিএসপি, সাড়ে ১৬ লাখ টন ডিএপি এবং সাড়ে আট লাখ টন এমওপি। এ ছাড়া অন্যান্য সারের চাহিদা প্রায় আট লাখ টন। এর মধ্যে দেশে ইউরিয়া সার উৎপাদন হয় ৯ থেকে ১০ লাখ টন। সব মিলিয়ে গত দুই অর্থ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হয়েছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আমদানি ব্যয় কমানো গেলে এই পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন নাও হতে পারে।