কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব কাটতে না কাটতেই নতুন সংকটে পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। বৈশ্বিক ঋণ স্থিতিশীল থাকলেও তা এখনো বিশ্ব অর্থনীতির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৩৫ শতাংশের বেশি। একদিকে সরকারি ঋণ দ্রুত বাড়ছে, অন্যদিকে বেসরকারি ঋণ কমছে—যা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গ্লোবাল ডেট ডেটাবেজ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত বছর বৈশ্বিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এর মধ্যে সরকারি ঋণ প্রায় ৯৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় বেশি। অন্যদিকে বেসরকারি ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০১৫ সালের পর সর্বনিম্ন।
সরকারি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—কোভিড-১৯ মহামারির সময় নেওয়া আর্থিক সহায়তা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা এবং উচ্চ সুদের হার। বহু দেশ সরকারি ভর্তুকি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সহায়তা কর্মসূচির খরচ বহন করতে গিয়ে বাজেট ঘাটতির মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ঋণ জিডিপির ১২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, চীনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮ শতাংশে। তবে জাপান ও গ্রিসের মতো উন্নত অর্থনীতিতে সরকারি ঋণ কমেছে, যা উন্নত দেশগুলোর সামগ্রিক ঋণ গড়কে কিছুটা হ্রাস করেছে।
আইএমএফের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সরকারি ঋণের এই বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষত, এটি ‘ক্রাউডিং-আউট’ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ, সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের জন্য ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায় এবং সুদের হার বাড়ে, যা বেসরকারি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে।
বেসরকারি ঋণের চিত্র দেশভেদে ভিন্ন। উন্নত অর্থনীতিতে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে, বেসরকারি ঋণ জিডিপির ৪.৫ শতাংশ কমেছে। এর পেছনে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের শক্তিশালী আর্থিক অবস্থা এবং দুর্বল প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ভূমিকা রেখেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন বিনিয়োগের ঝুঁকি না নিয়ে নগদ অর্থ জমা করছে।
অন্যদিকে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে প্রবণতা ভিন্ন। ভারত, ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে বেসরকারি ঋণ বেড়েছে। তবে চীনে ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে—সেখানে করপোরেট ঋণ বাড়লেও, আবাসন খাতের দুর্বলতা ও কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে পারিবারিক ঋণ হ্রাস পেয়েছে।
ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে আইএমএফ বলছে, দেশগুলোর উচিত বাস্তবসম্মত মধ্যম-মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যেখানে ধাপে ধাপে রাজস্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে সরকারি ঋণ কমানো হবে। একইসঙ্গে এমন একটি অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে যা প্রবৃদ্ধি বাড়াবে, অনিশ্চয়তা কমাবে এবং বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারি ঋণ বৃদ্ধি ও বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য সূক্ষ্ম ভারসাম্যহীনতা নির্দেশ করছে। সরকারি ঋণের বাড়তি বোঝা ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কার্যক্রমের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, আর বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে মন্থর করতে পারে। তাই আগামী দিনে নীতিনির্ধারকদের জন্য সরকারি ব্যয় ও বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে।