• ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দ্রোহ, প্রেম আর সাম্যের অমর গাঁথা কাজী নজরুল ইসলাম

সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত আগস্ট ২৭, ২০২৫, ১৫:২৪ অপরাহ্ণ
দ্রোহ, প্রেম আর সাম্যের অমর গাঁথা কাজী নজরুল ইসলাম
সংবাদটি শেয়ার করুন....

বিদ্রোহের অগ্নি মশাল, প্রেমের অনন্ত স্পর্শ আর সাম্যের মহিমান্বিত আহ্বান—এই তিন শক্তির সম্মিলনে গড়ে উঠেছে কাজী নজরুল ইসলামের অমর সত্তা। তিনি শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন বিদ্রোহের বজ্রনিনাদ, প্রেমের পূর্ণচন্দ্র, আর মানবতার চিরন্তন দূত। তাঁর কলমে যেমন ঝরে পড়েছে বিপ্লবের আগুন, তেমনি বেজে উঠেছে প্রেমের বাঁশি আর সাম্যের মহাগান। আজ প্রেম, সাম্য ও মানবতার কবির প্রয়াণ দিবস।

সম্রাট শাহ্ আলমের সময় তার পূর্বপুরুষেরা পাটনার হাজীপুর থেকে বর্ধমানের আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে আসেন। মোগল আমলে প্রতিষ্ঠিত এখানে এক বিচারালয়ে তাঁরা কাজীর (বিচারকের) পদ পান। কাজী নজরুল ইসলাম হলেন এই কাজীদেরই বংশধর। পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ। মাতার নাম জাহেদা খাতুন। কাজী ফকির আহমদের দুটি স্ত্রীর গর্ভে সাত পুত্র ও দুই কন্যা জন্মেছিল। কবির সহোদর তিন ভাই, এক বোন। কবি তার পিতার দ্বিতীয় পক্ষের দ্বিতীয় সন্তান।

বড় সন্তান সাহেবজানের জন্মের পর চার পুত্রের অকাল মৃত্যু হয়, তারপর জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল। বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। ঘটনাবহুল কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের মতোই তাঁর কাব্যের পটভূমিও বৈচিত্র্যময়। বিষয় বৈচিত্র্যে ও কল্পনায় নজরুলের কবিতা সমৃদ্ধ। তাঁর কবিতা সাধারণভাবে দুটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়—বিষয় নিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান এবং ব্যক্তিনিষ্ঠ ও কল্পনা প্রধান।

প্রথম পর্যায়ের কাব্য কবিতায় সমাজ, সমাজের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে নানা সমস্যা, বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, অভিযোগ, স্বদেশ, যুদ্ধ ঘোষণা প্রভৃতি দেখা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশুদ্ধ কবি মনের ভাব উচ্ছ্বাস, ব্যক্তিময়তা বা মৃন্ময়ভাব প্রাধান্য পায়। নজরুলের সমগ্র কাব্যকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বিভাজন করলে কয়েকটি বিভাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নজরুলের বস্তুনিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান কবিতাগুলির মধ্যে বিদ্রোহী, ফরিয়াদ, সাম্যবাদী, অন্ধস্বদেশ, দেবতা, কাণ্ডারী হুঁশিয়ার উল্লেখযোগ্য। এই কবিতায় রাজনৈতিক চেতনা ও বিদ্রোহের দীপ্তি প্রকাশ পেয়েছে। আমার কৈফিয়ৎ কবিতায় তিনি স্পষ্টই বলেছেন—প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস। যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।

বিদ্রোহী কবিতা তীব্র চিৎকারে ঘোষণা করেছে, “আমি সেই দিন হবো শান্ত যবে, উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা অত্যাচারীর ঘড়া কৃপাণ ভীম রণভূমে বসিবে না।” আবার বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার প্রেরণায় তিনি গেয়েছেন—নবীন মন্ত্রে দামিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী। জাগোরে জোয়ান, ঘুমায়ো না, ভূয়ো শান্তির বাণী শুনি।

কবি ধ্বংসের জয়গান গাইলেও তার মধ্যে নূতন জীবনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতির বিরুদ্ধে দেশনেতাকে হুঁশিয়ার করার সচেতনতাই কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতার মর্ম। বিপ্লববাদের মতোই নজরুলের সাম্যবাদী ইন্টারন্যাশনাল গীতি, কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, ধীবরের গান প্রভৃতি কবিতায় জাতিভেদহীন সাম্প্রদায়িকতা প্রতিফলিত।

বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কবিতার মধ্যেই নজরুলের প্রেম ও প্রকৃতির অপূর্ব সমাহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন, বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি, আমি গাই তার গান প্রভৃতি কবিতায় প্রেম চেতনা আত্মপ্রকাশ করেছে। কবি কুমিল্লায় থাকাকালীন তার ঘরের জানালার পাশে গুবাক তরুর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।

কাজী নজরুল শিশু বিষয়ক কাব্য, নাটক ও গানেও অনন্য অবদান রেখেছেন। খুকুও কাঠবিড়ালী, প্রভাতী, লিচুচোর, ঝুমকো লতায় জোনাকী, মটকু মাইতি, বাঁটকুল রায় প্রভৃতি কাব্য শিশুদের মধ্যে জনপ্রিয়। গান রচনায়ও নজরুলের প্রতিভা চমকপ্রদ; তাঁর গান আজ “নজরুলগীতি” নামে পরিচিত।

বাংলা কাব্য জগতে নজরুলের জনপ্রিয়তা ও কবি প্রতিভার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শীর্ষে। তবে যারা রবীন্দ্রকাব্য পরিমণ্ডলের বাইরে কাব্য সাধনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে নজরুল যুগচেতনার কবি। রোমান্টিকতা ও বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার যৌথতায় তাঁর কবিস্বভাব সমৃদ্ধ। আজও আমরা তাঁকে ভুলে যাইনি।

কবি আজ নিসর্গের নিস্তব্ধতায় নিদ্রিত, তবু তাঁর কলমের অগ্নিশিখা নিভে যায়নি। প্রেম, বিদ্রোহ আর সাম্যের যে অমর সুর তিনি তুলে গিয়েছিলেন, তা আজও আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত। নজরুল আমাদের চেতনার প্রহরী, আমাদের মুক্তির মশাল। তাঁর প্রয়াণে আমরা হারিয়েছি এক মহীরুহ, কিন্তু তাঁর বাণী অমরত্ব পেয়েছে যুগের পর যুগ।