আন্তর্জাতিকভাবে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারিগরি শিক্ষাকে। উন্নত অনেক দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর হারও বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে চাকরি না পেয়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ দিনদিন হারিয়ে ফেলছেন শিক্ষার্থীরা। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে কমছে শিক্ষার্থী।
দেশের ১২ হাজার কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত পাঁচ বছর ধরে অর্ধেকের বেশি আসন ফাঁকা ছিল। এছাড়া, নতুন টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক এবং অধ্যক্ষের পদ অর্ধেক শূন্য রয়েছে। দেশীয় ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারিকুলাম প্রণয়নের তাগিদ দিয়ে শিক্ষাবিদরা বলেন, দেশে কারিগরি শিক্ষার অবকাঠামো সম্প্রসারণ হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যায়নি।
পুরোনো পাঠক্রম, অপর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ-ল্যাব, দক্ষ শিক্ষকের অভাব ও দুর্বল ব্যবস্থাপনাসহ নানা সমস্যা জর্জরিত কারিগরি শিক্ষা। নেই হাতে-কলমে শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণ। সনাতন শিক্ষার কারণে আন্তর্জাতিক স্তরে সমমর্যাদা পাচ্ছে না বাংলাদেশের ডিপ্লোমা। ফলে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজগুলোয় (টিএসসি) শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য নির্ধারিত আসনের বেশির ভাগই প্রতি বছর ফাঁকা থাকছে। এমনকি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাজীবন শেষে উপযুক্ত কর্মসংস্থানেরও অভাবে রয়েছে। ফলে বেকার সংখ্যাও দিনদিন বাড়ছে। ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ইন্টারনেট অব থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লকচেইন টেকনোলজিসহ আধুনিক বিষয়গুলো কারিগরি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির পরামর্শ দেন শিক্ষাবিদরা।
দেশে উন্নত প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এক দশকে বিনিয়োগ হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কারিগরি শিক্ষা খাতেও বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম ৪২৯টি উপজেলায় ৪২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) নির্মাণের দুটি প্রকল্প। একটি প্রকল্পে ১০০টি এবং আরেকটি প্রকল্পের অধীন নির্মাণ হচ্ছে ৩২৯টি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছর পর্যন্ত এগুলোর মধ্যে ৯১টি টিএসসিতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য। প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ শিক্ষক ও প্রচারণার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এ প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পর এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষাবর্ষেই আসন সংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষার্থী পায়নি। প্রকল্প দুটির মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।
কিন্তু ৩৩৮টি টিএসসির নির্মাণকাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। কারিগরি বোর্ডের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল এমন ১৪৯টি টিএসসির প্রায় ৬২ শতাংশ আসনই ছিল ফাঁকা। এর মধ্যে ১৩৬টি টিএসসিতে চালু ছিল নিম্নমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট আসনসংখ্যা ২৬ হাজার ৬৫০। এর বিপরীতে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ১০ হাজার ৬০৩ জন। অর্থাত্ প্রায় ১৬ হাজার ৪৭টি আসনই শূন্য, যা মোট আসনের ৬০ দশমিক ২১ শতাংশ। একই অবস্থা এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সেও। এসএসসি (ভোকেশনাল) কোর্স চালু আছে ১৪৯টি প্রতিষ্ঠানে এবং আসনসংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ৬০০। এর বিপরীতে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ৩৮ হাজার ৬২০ জন। আসন ফাঁকা ছিল ৬৬ হাজার ৯২০টি, যা মোট আসনের ৬৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সে ১৪৯টি প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা ২৪ হাজার ৫০। শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ৯ হাজার ৯৯ জন। আসন ফাঁকা ছিল ১৪ হাজার ৯৫১টি, যা মোট আসনের ৬২ দশমিক ১৬ শতাংশ। সব মিলিয়ে ১৪৯টি প্রতিষ্ঠানে মোট আসন ছিল দেড় লাখের বেশি। নির্মাণাধীন ৩৩৮টি প্রতিষ্ঠান চালু হলে আসন বাড়বে প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৯২০টি।
শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না : কারিগরি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানগুলোয় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের প্রি-ভোকেশনাল এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কমপক্ষে চারটি করে ট্রেডে পড়াশোনা করানো হয়। এছাড়া, এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সসহ বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে সব কোর্স চালু আছে এমন প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ আসন ফাঁকা থাকছে। আগের ৬৪টিসহ বর্তমানে ১৫৫টি টিএসসির কার্যক্রম চালু রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৪২৯টি টিএসসি নির্মাণে ব্যয় হবে মোট ২৩ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। আওয়ামী সরকারের আমলে দুই দফায় সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
কারিগরি শিক্ষার মান না বাড়িয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষতা বাড়ানো খুবই জরুরি। শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে এ খাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্ররা পিছিয়ে পড়ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে নেওয়া হচ্ছে কি না, এতে কী ধরনের কারিকুলাম হবে, বৃত্তিমূলক শিক্ষার পাশাপাশি আদর্শ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি না এবং যন্ত্রপাতিগুলো আধুনিক কি না, সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার।