
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জিয়াউর রহমান এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি মৃত্যুপরবর্তী চার দশক পেরিয়েও রাজনীতির আলোচনায় একইভাবে জীবন্ত। তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব আজও অটুট। তিনি কেবল একজন রাষ্ট্রনেতা নন, বরং বাংলাদেশের আধুনিক রাজনীতির গঠনে অন্যতম স্থপতি, যাঁর আদর্শ ও কর্মকৌশল আজও রাজনৈতিক পরিসরে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ এক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক অস্থিরতার সময় পার করছিল। এমন এক সময়ে সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। তিনি রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করার জন্য কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেন এবং একই সঙ্গে একটি নতুন রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেন—বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই ধারণা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে হাজির হয়। তাঁর মতে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের মূল ভিত্তি কেবল জাতিগত নয়, বরং নাগরিকত্ব, ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্বনির্ভর। এই দৃষ্টিভঙ্গি দেশের রাজনৈতিক চিন্তায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে এবং এখনো দেশের রাজনীতিতে একটি বড় আদর্শিক বিভাজনের রেখা তৈরি করে রেখেছে।
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)—যা আজও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি। এই দল কেবল তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং তাঁর আদর্শ, রাষ্ট্রদর্শন ও রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতির প্রতিফলন। আওয়ামী লীগ যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক উত্তরাধিকার বহন করে, তেমনি বিএনপি জিয়াউর রহমানকে নিজের রাজনৈতিক ও নৈতিক ভিত্তি হিসেবে ধারণ করে আছে। ফলে বাংলাদেশে যে দ্বি-মেরু রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে—তার এক অর্ধেক জুড়ে আছেন জিয়াউর রহমান। এই মেরুকরণ যতদিন থাকবে, ততদিন তাঁর নামও থাকবে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে।
শুধু দলগঠনের রাজনীতি নয়, রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রেও জিয়াউর রহমান রেখেছেন স্থায়ী প্রভাব। তিনি বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করে অর্থনৈতিক মুক্তবাজারনীতি প্রবর্তন করেন, গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য স্বনির্ভরতা কর্মসূচি চালু করেন, এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করে—দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। তাঁর সেই “উন্নয়ন-রাষ্ট্র” চিন্তাধারা আজও বিভিন্ন সরকারি নীতিতে পরোক্ষভাবে প্রতিফলিত হয়।
তাঁর ব্যক্তিগত ভূমিকা নিয়েও রয়েছে ইতিহাসে এক অনিবার্য উপস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করেন।
আজকের বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান কেবল অতীতের স্মৃতি নন; তিনি এক রাজনৈতিক প্রতীক। তাঁর নাম উচ্চারিত হয় যেমন বিএনপির সভা-মঞ্চে, তেমনি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের বক্তব্যেও। তাঁকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার নায়ক বলা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁকে উপেক্ষা করা যায় না। তাঁর আদর্শ, তাঁর প্রবর্তিত রাজনৈতিক দর্শন এবং তাঁর রেখে যাওয়া দল—সব মিলিয়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান এখনো অপরিহার্য—কারণ তিনি কেবল একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বা দলপ্রধান নন; তিনি এক যুগের প্রতিনিধি, এক আদর্শের প্রতীক, এবং এক বিতর্কিত কিন্তু অমোঘ বাস্তবতা। ইতিহাসের পাঠ ও বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতা উভয়ই প্রমাণ করে যে, জিয়াকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে বোঝা সম্ভব নয়। তাই সময় যতই এগিয়ে যাক না কেন, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরকালই প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য থেকে যাবেন।