• ৩১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অবশেষে স্বস্তিতে নিকুঞ্জবাসি

সারাদেশের মডেল অটোরিকশা মুক্ত নিকুঞ্জ

মনির হোসেন জীবন
প্রকাশিত অক্টোবর ৮, ২০২৫, ১৮:২৫ অপরাহ্ণ
অবশেষে স্বস্তিতে নিকুঞ্জবাসি
সংবাদটি শেয়ার করুন....

রাজধানীর ব্যস্ততার ভেতরও যেন এক ব্যতিক্রমী শান্তির ঠিকানা নিকুঞ্জ। এলাকাবাসীর অটল ঐক্যবদ্ধ ও অসীম সাহসীকতার কারণে খিলক্ষেতের নিকুঞ্জে গত ছয় মাস ধরে ব্যাটারীচালিত অটোরিকসা চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে । একসময় নিকুঞ্জ এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বাহকটি কোমলমতি শিশু, বয়োবৃদ্ধ ও পথচারীদের জন্য আতঙ্কের নাম ছিল। এখন সেটি নেই। এখন পথচারীরা অনেকটাই নিশ্চিন্তে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেন। আর শিশু- কিশোররা সাইকেল চালিয়ে রাস্তাজুড়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। আজ নিকুঞ্জ থেকে অটোরিকসা সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ হয়েছে । গত পাঁচ মাসে এ এলাকায় কোনো দুর্ঘটনার খবর নেই বললেই চলে। অবশেষে দুর্ঘটনার হাত থেকে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছে নিকুঞ্জবাসি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্র,
এলাকাবাসী ও একাধিক তথ্য সূত্রের।

তথ্য অনুসন্ধ্যান ও নিকুঞ্জবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিকুঞ্জে অটোরিকশাকে একসময় “মরণযান” বলা হতো। প্রতিদিন সড়কে কোন না কোন জায়গায় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতো। এতে করে নিকুঞ্জবাসীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে গেল ৩০ এপ্রিল ২০২৫ নিকুঞ্জ টানপাড়া এলাকায় সর্বস্তরের মানুষ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন—এই এলাকায় আর কোনো ব্যাটারিচালিত অটোরিকসা চলবে না। এরপর গণআন্দোলন শুরু হয়। নিকুঞ্জবাসী সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ, মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে তারা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করেন। এলাকায় অটোরিকসা বন্ধ রাখার দাবিতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডিএমপি’র খিলক্ষেত থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বরাবর লিখিত অবহিতকরণও দিয়েছে।

আজ বুধবার বিকেলে সরেজমিনে নিকুঞ্জের টানপাড়া, জামতলা, সরকারবাড়ি ও পুরাতন বাজার এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়— ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা মুক্ত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শৃঙ্খলিত একটি সুন্দর পরিবেশ। বর্তমানে রাজধানীর নিকুঞ্জে পুরানো চেহেরা বদলে গিয়ে শান্ত ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরে এসেছে।

এ আন্দোলনে অংশ নেয়া অন্যতম সাহসী ব্যক্তি এবং স্থানীয় সিনিয়র সাংবাদিক জাহিদ ইকবাল এ প্রতিবেদককে বলেন, নিকুঞ্জে এ মরণযান বন্ধ করতে গিয়ে আমাদের সীমাহীন কষ্ট আর অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব, হুমকি-ধামকি, ভয়ভীতি এমনকি প্রশাসনিক বিভিন্ন ধরনের চাপও এসেছিল। কিন্তু এলাকাবাসীর অটল ঐক্যের কাছে সব ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যদি সবার মাঝে ঐক্য থাকে, তাহলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়।নিকুঞ্জবাসী সেটা প্রমাণ করেছে। স্থানীয় পথচারী জৈনক ফয়সাল ইমরান বলেন, অটোরিকসা বন্ধের মাধ্যমে আমরা যেন এক অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমার ছোট ভাই এক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এখন আমরা নিশ্চিন্তে মনের আনন্দে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারি।

পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ‍‍একসময়কার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হুমকি আর মৃত্যুর ভয়ে জবুথবু থাকা রাস্তায় এখন তারা নির্বিঘ্নে চলাচল করছেন। শিশু-কিশোররাও আনন্দের সঙ্গে সাইকেল চালাচ্ছে, দৌঁড়াচ্ছে। দীর্ঘ দিনপর ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের মাধ্যমে আমাদের পুরো এলাকা অভিশাপ মুক্ত হয়েছে। প্যাডেল রিকশাচালক ছদ্মনাম সেলিম কবির ও বদরুল আলম বলেন, ব্যাটারি রিকশার কারণে আমাদের প্রায় না খেয়ে মরার অবস্থা হয়েছিল। তারা যাত্রী ছিনিয়ে নিত, আমরা কেউ যাত্রী পেতাম না। অদক্ষ ও কমবয়সী চালকরা উচ্ছৃঙ্খলভাবে অটোরিকশা চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাতেন, আর দোষ পড়ত রিকশাচালকদের ঘাড়ে। এখন অটোরিকশা বন্ধ হওয়ায় মানুষ নিরাপদে চলাচল করতে পারছে, আর আমাদের রোজগারও বেড়েছে।
নিকুঞ্জ মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহাদাত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, নিকুঞ্জ এলাকায় প্রতিদিনই অটোরিকশার কারণে দুর্ঘটনা ঘটত। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও সোসাইটির সদস্যদের সম্মিলিত উদ্যোগে তা বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। এসব অটোরিকশার কারণে বহু বৃদ্ধ, পথচারী ও শিক্ষার্থী দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এখন সবাই নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারছেন। আমাদের কলেজ থেকেও খিলক্ষেত মডেল থানায় একটি আবেদন দেওয়া হয়েছে, যাতে পুনরায় অটোরিকশা চালু না হয়।

সচেতন নাগরিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সারাদেশে যেখানে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সময়ে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ; সেখানে নিকুঞ্জের অটোমুক্ত থাকার পাঁচ মাসের সাফল্য একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। নিকুঞ্জবাসী আজ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—জনগণ জেগে উঠলে কোনো অন্যায় বা অনিয়মই স্থায়ী নয়! নি:সন্দেহে বলা যায়, তারা সারা দেশের মধ্যে একটা মডেল স্থাপন করেছে। রাজধানীর গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকাগুলোতেও যেখানে প্রশাসনের প্রচেষ্টায় শত চেষ্টার পরও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠেছি। অটোরিকশা মুক্ত হওয়ায় যানজট ও শব্দদূষণ কমেছে। পরিবেশের হয়েছে উন্নতি। পাশাপাশি নাগরিক জীবনের স্বস্তি ফিরে এসেছে। এ অর্জন কেবল স্থানীয় সাফল্য নয়, এটি একটি সফল গণজাগরণের মডেল।

ডিএমপি’র খিলক্ষেত থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সাজ্জাত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, অটোরিকশা বন্ধে নিকুঞ্জ এলাকাবাসীর এ ধরনের উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। বর্তমানে এ এলাকায় দুর্ঘটনা প্রায় নেই বললেই চলে। এলাকাবাসীরাই এ এলাকার প্রকৃত মালিক ও অধিবাসী।