• ১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বেকারত্বের কারণে চুরি-ছিনতাই ডাকাতি বাড়ছে: উত্তরা-তুরাগ-টঙ্গীতে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি

মনির হোসেন জীবন, বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫, ১৮:১২ অপরাহ্ণ
বেকারত্বের কারণে চুরি-ছিনতাই ডাকাতি বাড়ছে: উত্তরা-তুরাগ-টঙ্গীতে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি
সংবাদটি শেয়ার করুন....

রাজধানীর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিমানবন্দর থেকে উত্তরা আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত এলাকাজুড়ে এখন ছিনতাইকারী ও নানাবিধ অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এছাড়া উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে শুরু করে আশুলিয়া সড়ক ও মিরপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেরিবাধ সড়ক ডাকাত, ছিনতাইকারী, চোরচক্র সক্রিয়সহ রয়েছে অপহরণকারীদের আখড়া। বিশেষ করে উত্তরা, তুরাগ ও টঙ্গী এলাকা অপরাধীদের অভয়ারণ্য। অপরাধী সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা দূর পাল্লার যাত্রীবাহী বাস, বিভিন্ন গণপরিবহন, লেগুনার যাত্রী, পথচারী ও ব্যবসায়ীরা থাকে আতঙ্ক। প্রশাসনের চোখের সামনে প্রকাশ্য একের পর এক ঘটছে চুরি- ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও খুনের মতো ঘটনা। যার ফলে পথচারী থেকে শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরায় সংঘটিত চুরি, ছিনতাই, খুন, ডাকাতি, অপহরণসহ অপরাধের বেশির ভাগ অপরাধী পার্শ্ববর্তী গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকার। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার বহিরাগত ও মৌসুমি কর্মহীন শ্রমিক কিংবা তরুণ যুবক বলে জানা গেছে। সড়কে ছিনতাইকারী ও অপরাধীদের হাতে নিহত ও আহতের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। খবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন তথ্য সূত্র ও একাধিক বিশ্বস্থ সূত্রের।

সংশ্লিষ্ট একাধিক তথ্য বলছে, গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল, তা এখনো কাটিয়ে ওঠার সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে গাজীপুর ও শিল্প নগরী টঙ্গী এলাকার পোশাক শিল্পে। কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, গত এক বছরে গাজীপুরে বন্ধ হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫টি পোশাক কারখানা, এর মধ্যে গত ছয় মাসেই বন্ধ হয়েছে ২৯ থেকে ৩৫টি কারখানা। এই বিপুল শ্রমিক একসঙ্গে চাকরি হারিয়ে পড়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। কেউ কেউ অন্য পেশায় যুক্ত হলেও একটি বড় অংশ কোনো কাজ না পেয়ে হতাশা থেকে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। অন্যদিকে গাজীপুর উত্তরার কাছাকাছি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে উত্তরা ও তুরাগেও।

স্থানীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র গুলো বলছে, উত্তরা, তুরাগ ও টঙ্গীতে সন্ধ্যার পর বাহিরে বের হওয়া ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। রাস্তায় কিংবা রাতের বেলায় এমনকি ভোরে অলিতে গলিতে এবং সড়ক-মহাসড়কে বিভিন্ন যানবাহনে চলাচল করার সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। কোন মুহূর্তে কাকে যে আক্রমণ করবে, সেটা বোঝার কোন উপায় থাকে না। কোন কোন সময় অপরাধীরা রিক্সা কিংবা সিএনজি গতিরোধ করে কমান্ডো স্টাইলে এসে দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এবং জিম্মি করে সর্বত্র ছিনিয়ে নিয়ে কৌশলে লাপাত্তা হয়ে যায়। তবে, অপরাধীদের বয়স বেশি নয়। ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী। পোশাক পরে ছিঁড়া ফাঁড়া, পায়ে থাকে স্যান্ডেল। মাথায় চুল হলো এলোমেলো স্টাইল করা। কেউ কেউ বলছে, অধিকাংশ ছিনতাইকারী, পকেটমার ও অপরাধী নাকি মাদকাসক্ত। মানে নেশাগ্রস্ত। মরন নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট, ড্যান্ডি ও বিভিন্ন নেশা জাতীয় ইনজেকশন সেবন ও স্যুই ব্যবহার করে থাকে।

শনিবার সন্ধ্যার পর ও আজ রোববার বিকেলে উত্তরা, টঙ্গী ও তুরাগের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেরিবাধ সড়ক সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মহাসড়ক ও সড়ক এবং বাসস্ট্যান্ডে সর্বস্তরের মানুষের জটলা। শিশু থেকে বয়স্ক মানুষের প্রচন্ড ভীড়। ফ্লাইওভার দিয়ে দ্রুত গতিতে দূর পাল্লার গাড়ি ও যাত্রীবাহী বাসগুলো ছুটে চলছে। কেউ কেউ ডেকে ডেকে যাত্রীও উঠাচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে মধ্যরাত কিংবা ভোর রাত পর্যন্ত ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পথে ঘাটে সক্রিয় থাকে পেশাদার ছিনতাইকারীরা। তাদের হাতে থাকে দেশীয় ও ধারালো আগ্নেয়াস্ত্র। আর দামি মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারে করে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার ছিনতাইকারী ও অপরাধীরা শিকারের আশায় ফ্লাইওভার দিয়ে ঘুরঘুর করে। আবার সুযোগ পেলে প্রশাসনের চোখের সামনেই দিন-দুপুরেই করছে এসব অপরাধ। বিশেষ করে টঙ্গীর বাস্তহারা, কলেজ গেইট, চেরাগ আলী, মিলগেইট, স্টেশন রোড, মাছিমপুর, বাটাগেইট, আশরাফ সেতু, টঙ্গী বাজার, টঙ্গী ব্রিজ, কামার পড়া ব্রিজ, উত্তরার আব্দুল্লাহ, হাউজ বিল্ডিং, বিএনএস সেন্টার, আজমপুর, রাজলক্ষ্মী, জসিমউদ্দীন, বিমানবন্দর ও কাওলা ব্রিজ বাসস্ট্যান্ড, ফ্লাইওভার ও ফুটওভার ব্রিজগুলো হলো অপরাধীদের ঘাঁটী। এছাড়া উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে শুরু করে আশুলিয়া সড়ক ও মিরপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেরিবাধ সড়ক অপরাধীদের দখলে। রাস্তায় হঠাৎ বেড়েছে অটোরিকশা ও সিএনজি চালকদের সংখ্যাও। বিশেষ করে তুরাগের কামারপাড়া, ধউর বেরিবাধ, স্ল্যুইচগেইট, পঞ্চবটী, বিরুলিয়া ব্রিজ, আশুলিয়া ব্রিজ, প্রত্যাশা মাঠ ও তুরাগের ১৭, ১৮ নং সেক্টর ও মেট্রোরেল এলাকা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। মাঝেমধ্যে এসব স্থানে এবং উত্তরা লেক ও তুরাগ নদীতে অজ্ঞান লাশ (মরদেহ) পাওয়া যায়। তার মধ্যে অনেকের পরিচয় পাওয়া গেলেও বাকিদের পরিচয় মেলে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, গাজীপুরে চাকরি হারানো অনেকেই জীবিকার উপায় হিসেবে রিকশা চালানো শুরু করেছে। তবে কেউ কেউ রিকশার আড়ালে ছিনতাই কিংবা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।

টঙ্গী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, টঙ্গী এলাকার ব্যবসায়ী ও পথচারীরা প্রতিদিন কেউ না কেউ চুরি, পকেটমার কিংবা ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। রাস্তাঘাটে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা থাকলেও অপরাধীদের সংখ্যা আগের চেয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

উত্তরার আব্দুল্লাহপুর এলাকার জাহাঙ্গীর ও মহসীন নামে দু’বাসিন্দা বলেন, শুধু মাত্র বেকারত্বের কারণে টঙ্গী, উত্তরা ও তুরাগ এলাকায় অপরাধীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সকাল-বিকেল আব্দুল্লাহপুর ও টঙ্গী ব্রিজ ফ্লাইওভার ও বাসস্ট্যান্ডে হয় ছিনতাই। মধ্যরাত ও ভোরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। প্রকাশে উঠে উঠতি বয়সের অপরাধীরা এসব এলাকা গুলোকে তাদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে উত্তরা ও টঙ্গী ভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা এবং প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। সে কারণেই অপরাধীরা দিনদিন সক্রিয় হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা গেছে, গত (২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) ইং ছিনতাইয়ের অভিযোগে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানার বিএনএস ভবনের সামনে ২জন ব্যক্তি গণপিটুনির শিকার হন। উত্তরা পশ্চিম থানার (এসআই) মো. মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের জানান, এঘটনায় বকুল (৪০), নাদিম (৩৫)কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গণপিটুনি দিয়ে তাদেরকে ফুটওভারব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

অপরদিকে গত (৬ অক্টোবর, ২০২৪) ইং ভোরের দিকে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় ছিনতাইকারীর আঘাতে সোহান (২৭) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। পাবনা জেলার সদর থানার নাজিরপুর এলাকায় কুব্বক আলীর ছেলে পুত্র। সে পেশায় একজন শ্রমিক। এ সময় কয়েকজন ছিনতাইকারী তার বুকে ছুরিকাঘাত করে এবং মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। নিহত যুবকের বুকের বাম পাশে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার আগেই মৃত্যু হয়।

এছাড়া গত (২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) রাতে গাজীপুরের টঙ্গীর মাছিমপুর এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে অজ্ঞাতনামা (২৬) নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয় থানা পুলিশ ওই যুবকের নাম-পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, মরদেহ উদ্ধার করে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

গত (১১ আগস্ট, ২০২৫) ইং সকাল আনুমানিক ৮টার দিকে গাজীপুরের টঙ্গী মিলগেট এলাকায় জনতার গণপিটুনিতে অজ্ঞাত এক যুবকের (২২) মৃত্যু হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঘটনার দিন সকালে একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে মোবাইল ফোন ছিনতাই করে পালিয়ে যায় ওই যুবক। এ সময় জনতা ধাওয়া দিয়ে তাকে আটক করে গণধোলাই দেয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।