• ১৫ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জনমতের সঠিক প্রতিফলন না ঘটার আশঙ্কা

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত নভেম্বর ১৫, ২০২৫, ১২:৫৩ অপরাহ্ণ
জনমতের সঠিক প্রতিফলন না ঘটার আশঙ্কা
সংবাদটি শেয়ার করুন....

জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশে যে পদ্ধতিতে গণভোটের কথা বলা হয়েছে, তা জনমতের নিখুঁত প্রতিফলন নিশ্চিত করতে পারবে কি না—এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন নির্বাচন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, যে চারটি প্রস্তাব বা প্রশ্ন নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, সেগুলো সাধারণ মানুষের বোঝার সীমার বাইরে। তাই ভোটারদের এসব বিষয়ে সচেতন করতে হলে ব্যাপক প্রচার চালানো জরুরি। পাশাপাশি যে নজিরবিহীন উপায়ে এই আদেশ জারি হয়েছে, তাও ভবিষ্যতে আইনি জটিলতার মুখে পড়তে পারে। নির্বাচন কমিশন আগামীকাল রবিবার বিষয়টি নিয়ে তাদের করণীয় নির্ধারণে বৈঠকে বসতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ায়ও মতভেদ রয়েছে। বাম রাজনৈতিক দলগুলোর মত, গণভোট নয়—জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে গণভোটের জন্য যে প্রস্তাবগুলো উল্লেখ আছে, সেগুলো পরিষ্কারভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। তিনি গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো ব্যাপক প্রচার। রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে জনগণকে বিষয়টি বুঝাতে হবে। নইলে অনেকেই ভোটে অংশ নাও নিতে পারেন। সংসদ নির্বাচনের ব্যালটে ভোটারদের পরিচিতি আছে, কিন্তু গণভোটের ক্ষেত্রে সে রকম ধারণা নেই। তাই প্রশ্নগুলো কীভাবে, কী বিষয়ে—এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইনের ভাষ্য অনুযায়ী জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। ভবিষ্যতে সংসদ যদি প্রথম অধিবেশনে এই আদেশ বাতিল করে, তাহলে কী হবে—সেটিও অনিশ্চিত। রাষ্ট্রপতির আদেশ বাতিলের এখতিয়ার সংসদের রয়েছে। ফলে অনেক বিষয় আইনের বাইরে গিয়ে করা হচ্ছে। গণভোট যেভাবে হতে যাচ্ছে, তাতে সিদ্ধান্ত হয়তো পরিপূর্ণভাবে বুঝে নেওয়া হবে না।

তার পরও জনসচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা জরুরি।’ সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ আদেশ যেভাবে জারি হয়েছে, তার কোনো নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির এমন আদেশ জারির এখতিয়ার নেই।’ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য বেগম জেসমিন টুলি মনে করেন, গণভোটে মতামত জানানো সহজ হবে না, বরং এতে জনমতের সঠিক প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে। ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালের দুটি গণভোটে দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেসব প্রশ্ন এবারের মতো জটিল ছিল না। ১৯৮৫ সালের গণভোটে জনমতের তুলনায় ক্ষমতাসীন পক্ষের ইচ্ছাই প্রতিফলিত হয়েছে বলে ধরা হয়।’ ১৯৮৫ সালে এরশাদের সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রশ্ন ছিল—রাষ্ট্রপতি এরশাদের নীতি সমর্থন করেন কি না এবং নির্বাচিত সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত তিনি প্রশাসন চালাবেন কি না।

সেখানে দাবি করা হয়, ৯৪.৫ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট এবং মোট ভোট পড়েছিল ৭২.২ শতাংশ। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের গণভোটে ভোটারদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল—দ্বাদশ সংশোধনী বিল (সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রবর্তন) রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাওয়া উচিত কি না। এতে ৮৩.৬ শতাংশ ভোট পড়ে পক্ষে। জেসমিন টুলি বলেন, ‘এবারের চারটি প্রস্তাব বুঝতে সক্ষম ভোটার খুব কম। বিশেষ করে বয়স্ক নারীদের বড় একটি অংশ এসব পড়েও বুঝতে পারবেন না। প্রতিটি প্রস্তাবে বেশ কিছু জটিল বিষয় রয়েছে, যেগুলো জানাতে প্রচুর সময় ও প্রচার দরকার।’ রবিবার ইসি বৈঠকে বসবে—জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ জানান, কমিশনের সভায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে আলোচনা হবে এবং গণভোটের প্রস্তুতি, ব্যালট বক্স ও ব্যালট পেপার সংগ্রহসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায়, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গণভোট আয়োজনকে স্বাগত জানালেও বলেন, আদেশটি সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলেছে এবং রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে এ ধরনের আদেশ জারি করা অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার নয়। বিএনপি–জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভক্তি পরিহার করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তাঁর মতে, বিভিন্ন পক্ষকে সমন্বয় করে সরকার যে সমাধানমূলক সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তা এখন তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য। বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট দিলে রাজনৈতিক ঐক্যের বদলে বিভক্তি বাড়তে পারে এবং দেশ দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়তে পারে।

সংবিধানে আদেশ জারির বিধান নেই, রাষ্ট্রপতি শুধু অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। এভাবে আদেশ জারি সংবিধানবিরোধী।’ তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ নেই, অথচ ১৭ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা যে সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন তাতে তা ছিল। এখন যেভাবে গণভোটের কথা বলা হচ্ছে, তাতে নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেওয়া ড. ইউনূসের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দলের ওপর চাপ প্রয়োগের শামিল।’