
অবশেষে বেনাপোল কাস্টমস ও সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা শেষে স্বাভাবিক হয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। এর ফলে সীমান্তজুড়ে স্থবির হয়ে পড়া বাণিজ্যে প্রাণ ফিরে এসেছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন দুই দেশের ব্যবসায়ীরা।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা (কিছু ক্ষেত্রে ১১টা) পর্যন্ত কাঁচামাল ব্যতীত অন্যান্য সব পণ্যবাহী ট্রাক বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করতে পারবে। আর কাঁচামালবাহী ট্রাক সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রবেশ করবে। বিশেষ প্রয়োজনে কাঁচামালের সময়সীমাও কিছুটা বাড়ানো হতে পারে।
বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কামাল উদ্দিন শিমুল বলেন, “রোববার সকালে কাস্টমস কমিশনার মহোদয়ের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দের এক মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন।”
এর আগে বৃহস্পতিবার থেকে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে কাগজপত্রবিহীন ও চোরাইপণ্য অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সন্ধ্যা ৬টার পর সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। এতে দুই দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দরে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় এবং সীমান্তজুড়ে পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়।
ভারতীয় পক্ষের উদ্বেগ এ পরিস্থিতিতে ভারতের পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন রোববার সকালে ভারতের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে ইমেইলে জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়। তারা উল্লেখ করে, বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত করিডোরের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রবাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা দুই দেশের স্থিতিশীল বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর হুমকি তৈরি করছে।
চিঠিতে তারা সতর্ক করে জানায়, মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তারা সাময়িকভাবে এই পোর্টের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বন্ধ রাখতে বাধ্য হবেন।
ভারতীয় সিএন্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, “বাংলাদেশের একতরফা সিদ্ধান্তে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রতিদিন পেট্রাপোল বন্দরে দেড় হাজারেরও বেশি ট্রাক আটকে রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের এনবিআর চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানিয়েছি। পরে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়েছে জেনে স্বস্তি পেয়েছি।”
বাণিজ্যে বড় ক্ষতি
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, সিদ্ধান্তের কারণে প্রতিদিন প্রায় ১০০-১৫০ কোটি টাকার পণ্য খালাসে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল। এতে ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি সরকারও প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব হারায়। প্রতিদিন গড়ে ২০০-২৫০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে এই বন্দর দিয়ে।
আগে প্রতিদিন গড়ে ৪০০-৪৫০ ট্রাক বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করলেও সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার পর তা নেমে আসে ১৮০-২০০ ট্রাকে। ফলে ফল, সবজি, মাছ, কসমেটিকস, রাসায়নিক কাঁচামালসহ দ্রুত পচনশীল পণ্যের বিপুল পরিমাণ ট্রাক সীমান্তে আটকে যায়।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, “কাস্টমস ও ব্যবসায়ীদের আলোচনার পর বিষয়টির সমাধান হওয়ায় আমরা খুশি। বন্দর পরিচালনা কর্তৃপক্ষ হিসেবে আমরা ব্যবসায়ী ও কাস্টমসকে সব ধরনের সহযোগিতা করবো।”
কাস্টমসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “বিষয়টি আসলে ভুল ব্যাখ্যার কারণে ঘটেছিল। কাঁচামালের ক্ষেত্রে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আমদানির কথা বলা হলেও একটি মহল সব পণ্যের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ হয়েছে বলে ভুলভাবে প্রচার করে। প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাবে সাময়িকভাবে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, যা এখন সমাধান হয়েছে।”
২০১৭ সালের ১ আগস্ট দুই দেশের সিদ্ধান্তে বেনাপোল-পেট্রাপোল ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) ২৪ ঘণ্টা চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সব কাস্টমস হাউসকে ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু বেনাপোলে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রশাসনিক জটিলতা ও সমন্বয়ের অভাবের কারণে এ ধরনের সংকট বারবার তৈরি হচ্ছে।
দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীরা আশা করছেন, সাম্প্রতিক এই সমঝোতার মাধ্যমে বেনাপোল-পেট্রাপোল বাণিজ্য আবারও পুরনো গতিতে ফিরে আসবে।