*পারস্পরিক বোঝাপড়া (Understanding) জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়—কোথাও বোঝাপড়ার অভাব থাকলে কল্যাণ ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। জাতীয় জীবনে শান্তি ও উন্নতির জন্য রাজনৈতিক বোঝাপড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, দুঃখজনকভাবে আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছি।*
### *স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক বিভক্তি*
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কোনো সুযোগই ছিল না। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগই তখন দেশের একচ্ছত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সক্রিয় ছিল। স্বাধীনতার পূর্বে সক্রিয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়, ফলে নবগঠিত রাষ্ট্রের জনগণ সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। রাজনৈতিক বিরোধীদের নিপীড়ন করা হয় এবং তারা চরম দুঃখ-দুর্দশার শিকার হন।
এই সময়ে জাতিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়—*মুক্তিযুদ্ধপন্থী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি।* তবে অল্প সময়ের মধ্যেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর উত্থানের মাধ্যমে রাজনীতিতে উগ্রবাদ দেখা দেয় এবং প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার পরিবর্তে দ্বন্দ্বমূলক রাজনীতির জন্ম হয়।
### *১৯৭৫ সালের পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা*
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তার শাসনের অবসান ঘটে। এরপর চার মাস ধরে দেশ এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে পড়ে। ৩ থেকে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত, বিশেষ করে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের পতনের সময়, পুরো দেশ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল।
৭ নভেম্বর ‘সিপাহী-জনতা বিপ্লব’-এর মাধ্যমে মেজর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন, যিনি ইতোমধ্যেই জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনিই প্রথমবারের মতো *রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ওপর গুরুত্ব দেন* এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি টেকসই রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। একজন সেনা কর্মকর্তা থেকে গণতান্ত্রিক নেতা হয়ে ওঠা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।
### *এরশাদ শাসন ও পুনরায় বিভক্তি*
জিয়াউর রহমানের শাসনের পতনের পর এরশাদের সামরিক শাসন আবারও রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের মাধ্যমে জনগণ রাজনৈতিক বোঝাপড়ার আলো দেখতে শুরু করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
গত পনেরো বছরে শেখ হাসিনা তার পিতার নীতিগুলো অনুসরণ করে দেশকে আরও একবার বিভক্ত করেছেন। তার শাসনামলে *বিরোধী দলগুলোর ওপর কঠোর দমননীতি আরোপ করা হয়* এবং তাদের রাজনৈতিক ময়দানে টিকে থাকার ন্যূনতম সুযোগও দেওয়া হয়নি। *বিএনপিকে ‘জনবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, জামাতকে ‘জঙ্গিবাদী’ তকমা দেওয়া হয়, এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কার্যক্রম কঠোরভাবে দমন করা হয়।*
### *জুলাই বিপ্লব ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার নতুন সূচনা*
গত ১৫ বছরে বিএনপি ও জামাত চরম নিপীড়নের শিকার হয়েও *পরিবর্তনের আশা ছাড়েনি।* জনগণও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছিল। *২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সময় সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসে।* তারা জীবন উৎসর্গ করে এবং প্রচণ্ড দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করেও এই বিপ্লবকে সফল করে তোলে।
এই বিপ্লব *কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর একক অর্জন নয়।* বরং এটি পুরো জাতির সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। তবে *ছাত্রদের ভূমিকা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, এবং তারা জাতির সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার দাবিদার।*
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো *স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে।* বর্তমানে দলগুলো *নতুন বাংলাদেশের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।* বিশেষ করে, ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল *ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (NCP)* ইতিমধ্যেই স্বতন্ত্রভাবে কাজ শুরু করেছে। বিএনপি, জামাতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত *NCP-কে স্বাগত জানানো* এবং তাদের সঙ্গে গঠনমূলক রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
### *ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তা*
বর্তমান সরকার এবং সব রাজনৈতিক দলের উচিত পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। *বিএনপি, জামাত ও NCP-এর মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা উচিত এবং পরস্পরকে দোষারোপের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।*
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার *রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে।* তবে এখনো তারা *নির্বাচনের তারিখ, সাংবিধানিক সংস্কারসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।*
ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বোঝাপড়ার অভাব থাকলে দেশ আবারও শূন্যে ফিরে যাবে। *অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুরা এই সুযোগকে কাজে লাগাবে, এবং পরবর্তী প্রজন্ম অজানা সময় পর্যন্ত দুর্ভোগের শিকার হবে।* তাই আমাদের এখনই সঠিক পথে এগোতে হবে, যেখানে *সকল রাজনৈতিক দল পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কাজ করবে এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে।*
*বাংলাদেশের রাজনীতি আর কখনো যেন বিভক্তি ও প্রতিহিংসার পথে না হাঁটে, সেটিই আজকের প্রধান চাওয়া।