বর্তমান সরকারের শাসনামলে দেশবাসী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করলেও ঘটেছে তার উল্টো। রাজধানীর তুরাগ-উত্তরা বিভাগে গত ১৩ মাসে আগের চেয়ে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি দেখা দিয়েছে। একের পর এক অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড ঘটেই চলছে। তার মধ্যে রয়েছে – আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা, মারামারি, হাতাহাতি, সংঘর্ষ, মামলা, আটক, ভাংচুর, থানা অবরোধ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনা উল্লেখযোগ্য । বিশেষ করে উত্তরা বিভাগের বিভিন্ন থানা এলাকায় চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, খুন, ডাকাতি, লুটপাট ও আতঙ্ক দিনদিন বেড়েই চলেছে। ধর্ষণ, অপহরণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনাও তুলনামূলক বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে মামলার সংখ্যা ও । অনেক এলাকায় সন্ধ্যার পর মানুষ বাসার বাইরে বের হতে ভয় পায়। এ অবস্থায় কোনো কোনো এলাকায় চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ । অনেক সময় এলাকাবাসি ও সাধারণ মানুষ নিজেরাই অপরাধ ঠেকাতে রাত্রি জেগে দলবেঁধে নিজ নিজ এলাকার বাড়িঘর পাহারার ব্যবস্থা করছে। খবর একাধিক বিশ্বস্থ তথ্য সূত্রের।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, ঢাকায় গত আগস্ট থেকে ছিনতাইয়ের ঘটনা বহুগুণ বেড়েছে । ধর্ষণ, অপহরণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে। পাশাপাশি মামলার সংখ্যা ও বেড়েছে।
কারণ ছিনতাইয়ের শিকার বেশির ভাগ পথচারী মামলা করে না। হয়রানির আশঙ্কায় তারা মামলা করতে চায়ও না। পুলিশের দাবি, রাজধানীর সীমান্তবর্তী থানাগুলোতে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে তুরাগ, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব, দক্ষিণখান, উত্তরখান, রূপনগর, শাহআলী, পল্লবী, দারুসসালাম, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর, আদাবর, হাজারীবাগ, ডেমরা, শনির আখড়া ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় বেশি অপরাধের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ জানিয়েছে, এসব এলাকায় বস্তি থাকায় সেখানে মাদক ও চোরাচালান কেন্দ্রিক অপরাধীরা থাকে, তারা অপরাধ করে ডিএমপি এলাকা থেকে বের হয়ে পাশ্ববর্তী গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ চলে যায়। তাই তাদের সহজে ধরা যায় না।
তথ্য অনুসন্ধ্যান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরার উত্তরখান, দক্ষিণখান, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত,
তুরাগের দিয়াবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকার মসজিদ থেকে গভীর রাতে ও ভোরে ডাকাত আতঙ্কে মাইকিং করা হয়। এছাড়া অনেক এলাকায় পাহারায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে উত্তরাবাসী। চলতি বছরের গত ৭ ও ৮ আগষ্ট ডাকাতির অভিযোগে এবং ডাকাত সন্দেহে ঢাকা -১৮ আসনের বাসিন্দারা উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টর এলাকা থেকে দেশীয় অস্ত্রসহ ৯ জনকে, উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টর থেকে ৩ জন, ১০ নম্বর সেক্টর থেকে ২ জনকে, ৮ নম্বর সেক্টর থেকে ১ জন এবং উত্তরখানের বালুরমাঠ এলাকা থেকে ডাকাত সন্দেহে ১ জনকে আটক করে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছে ছাত্র-জনতা ও এলাকাবাসী ।
ডিএমপি’র উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মুহিদুল ইসলাম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের জানান, গত ১৪ জুন সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে উত্তরা পশ্চিম থানার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডে নগদের স্থানীয় ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের এমডি আব্দুল খালেক নয়নের বাসা থেকে দু’টি ব্যাগে ভরে দু’টি মোটরসাইকেলে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ এর বেশি টাকা নিয়ে রওনা দেন চার জন ব্যক্তি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছে, কালো রঙের হাইচ গাড়ি মোটরসাইকেল দু’টির গতিরোধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোষাক পরা ৮ থেকে ১০ জন ব্যক্তি অস্ত্রের মুখে ওই চার জনকে জিম্মি করে টাকা ভর্তি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এঘটনায় গেল (১৯ জুন, ২০২৫) রাত ১টা ৪৫ মিনিটে রাজধানী থেকে ওই পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ছিনতাইকৃত নগদ টাকা ও ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।
ঘটনার বিবরণ ও প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০২৫ সালের ২৩ মে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের আশুলিয়া-আব্দুল্লাহপুর মহাসড়কের পাশে ফ্লাইওভারের ১৫৩ নম্বর পিলারের কাছে একটি ফাঁকা জায়গায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের ৬জন সদস্যকে দেশীয় অস্ত্রসহ আটক করে। তারা হলেন- রাসেল মিয়া (২২), মো. সাগর (১৯), নাহিদ মিয়া (১৯), সুমন বাবু (৩১), জাফর মোল্লা (২২) ও আবদুল আজিজ (২২)। পুলিশের দাবি, তাঁদের সবাই একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে তিনটি চাপাতি, দুটি চাকু ও একটি লোহার রড উদ্ধার করা হয়। তবে এ সময় কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা ডাকাতির পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা হয়েছে।
ডিএমপি’র উত্তরা-পূর্ব থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ১৮ এপ্রিল, ২০২৫ দুপুরে উত্তরা পূর্ব থানার বিএনএস সেন্টারের বিপরীতে একটি প্রাইভেটকারে কয়েকজন লোক অজ্ঞাত এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে ঢাকা- ময়মনসিংহ হাইওয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাটির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তা উত্তরা-পূর্ব থানা পুলিশের নজরে আসে। থানার একটি টিম ঘটনাস্থল ও এর আশেপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ও প্রযুক্তির সহায়তায় অপহরণকারী ও অপহরণে ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি শনাক্ত করে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়া মাস্ক পরা এক ব্যক্তিকে জবরদস্তি করে প্রাইভেট কারে তোলেন ৩ ব্যক্তি। এরপর গাড়িটি বিমানবন্দরের দিকে দ্রুত চলে যায়। ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনার পর ২৮ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে হাসানুজ্জামান শাওন (৩৬)কে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে অপহরণের কাজে ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি জব্দ করা হয়েছে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জের পূর্ব চনপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে আমির হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, ৪ জন মিলে ভুক্তভোগী আরিফ হোসেন (৩২)কে অপহরণ করে রূপগঞ্জে নিয়ে যায় এবং পাওনা টাকা আদায়ের পর তাকে ছেড়ে দেয়। এঘটনায় অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে উত্তরা-পূর্ব থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ জানান, এক স্কুলছাত্রীকে রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসা থেকে বাইরে যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে নিখোঁজ হন। এঘটনার ২ দিন পরে গত ২৮ মে,২০২৫ রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ভিকটিমের মায়ের মোবাইল ফোনে কল করে মেয়েকে উদ্ধারের জন্য ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। এ বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে থানায় জানানো হলে পুলিশ প্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান পরিচালনা করে ভিকটিমকে উদ্ধার এবং পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ বলছে, উত্তরা পশ্চিম থানার ১১ নম্বর সেক্টরের ১০/বি রোডের বাসা নম্বর ৩৭-এর দ্বিতীয় তলা থেকে অপহরণকারী চক্রের পেশাদার পাঁচ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তাররা হলেন- মো.মাসুম পারভেজ (৩৮), মো. সোলাইমান হোসেন (৩৮), শফিকুল ইসলাম সৌরভ (২৭), মোছা. মায়া (২৫) ও মোছা. রুলি খানম (১৯)। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে বিভিন্ন সময় মুক্তিপণ আদায় করা এক কোটি ৪১ লাখ টাকা, ৬০ পিস ইয়াবা, দুটি সিসি ক্যামেরা এবং তিনটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
পুলিশের দাবি, গ্রেপ্তাররা একটি পেশাদার অপহরণকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কিশোরীদের অপহরণ করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে আটকে রাখতেন। এরপর ভিকটিমদের নগ্ন ভিডিও ও ছবি ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করতেন অপহরণকারীরা।
গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে সংশ্লিষ্ট থানায় তিনটি পৃথক মামলা রুজু করা হয়েছে।
তথ্য অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, গত ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫ বিকেলে পূর্ববিরোধের জের ধরে তুরাগের রানা ভোলা সিরাজ মার্কেট এলাকায় ফারদিন শাহরিয়ার ওরফে শুভ (২৫)কে ছুরিকাঘাত করেন রিয়াজ। এঘটনার পরে শুভকে উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে রিয়াজকে আসামি করে তুরাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। তুরাগ থানা পুলিশ বলছে, বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন ফারদিন শাহরিয়ার। তুচ্ছ ঘটনা ও পূর্ব শত্রুতার জের হিসেবে হত্যা মামলার আসামি রিয়াজের সঙ্গে ফারদিনের গন্ডগোল হয়। রিয়াজ মাদকসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
ডিএমপি’র তুরাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান,
গত ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সকালে তুরাগ থানার ১৭ নম্বর সেক্টরের ১নং রোড জি- ব্লক খেলার মাঠের উত্তর পার্শ্বে ইসকন মন্দিরের পূর্ব পাশ কাঁশবনের ভেতর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে । পুলিশ বলছে, নিহত নারীর পরনে ছিল লাল রংয়ের জামা ও কালো পায়জামা । গলায় ওড়না পেঁচানো, শরীরে পঁচাগলা ও পোকায় ধরা ছিল। এব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, পুলিশ তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ বদ্ধপরিকর। যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলার
সমসাময়িক বিষয় নিয়ে এক প্রেসব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলাসহ প্রতিটি ঘটনা আমরা তদন্ত করে দেখব। যারা এর জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।