শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দমনমূলক ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের পতনের পর আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, ন্যায়ের শাসন নিশ্চিত করা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা, বৈষম্যের অবসান এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষিত করা। কিন্তু বাস্তবে কি আমরা সেসব লক্ষ্য পূরণের পথে এগোচ্ছি?
আমরা ক্ষুব্ধ ছিলাম কারণ শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিলেন। তার অহংকার, স্বেচ্ছাচারিতা এবং জনবিচ্ছিন্নতা দেশের মানুষের কাছে তাকে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বাধ্য করে। দুর্নীতির দেয়াল তাকে জনগণের আওয়াজ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। জাতিসংঘের তথ্য মতে, ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালিয়ে ১৪০০ জনকে হত্যা করার পর তিনি ক্ষমতা হারান।
তাহলে এখন প্রশ্ন—আমরা কি সত্যিই গণতন্ত্রের পথে এগোচ্ছি?
বর্তমান শাসনব্যবস্থায় কি সাধারণ মানুষের মতামত প্রতিফলিত হচ্ছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে হুমকি, আল্টিমেটাম ও চাপ প্রয়োগ করে সরকার গঠনের এই সংস্কৃতি কি গণতান্ত্রিক? নাকি এটি নতুন ধরনের কর্তৃত্ববাদ?
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সবাই আশা করেছিল দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছেন। কিন্তু সরকারের কিছু উপদেষ্টা মেয়াদ বাড়াতে চাইছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংস্কারকে অজুহাত বানিয়ে এই সময় বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় স্পষ্ট দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।
৬টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়ার চার মাস পার হলেও সেসব নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এই ধীরগতির ফলে জনগণের মধ্যে সংশয় তৈরি হচ্ছে।
সরকারি দায়িত্ব বণ্টনের দিকেও প্রশ্ন উঠেছে।
একজন উপদেষ্টার হাতে একসাথে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়, আবার আরেকজনের কাছে আইন ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়—এভাবে দায়িত্ব ভাগ করে দিলে কার্যকর প্রশাসন চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক ও রেল—সব এক উপদেষ্টার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আবার পররাষ্ট্র বিষয়ে তিনজন উপদেষ্টা কাজ করছেন, যার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার রোহিঙ্গা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক ভূমিকা নিয়েও জনমনে উদ্বেগ রয়েছে। এসব পরিস্থিতি প্রশ্ন তোলে—এই সরকার আদৌ স্বচ্ছ ও কার্যকর?
বর্তমানে কেবল ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা, আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও তার প্রতি জনগণের আস্থার কারণেই এই সরকার টিকে আছে। কিন্তু এটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়। একটি নির্বাচিত সরকারই পারে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং জাতিকে স্থায়ী পথে এগিয়ে নিতে।
আমরা অতীতে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা দেখেছি—তারা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কিছুই করেনি। তারপরও জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া গণতন্ত্র সম্ভব নয়। একটি সম্মানিত ব্যক্তির প্রতি আস্থার ভিত্তিতে অকার্যকর ও অনির্বাচিত সরকার টিকিয়ে রাখা কোনো জাতির অগ্রগতির পথ হতে পারে না।
সুত্র: দ্য ডেইলি স্টার