মানুষের জীবন কখনো নিছক জৈবিক চাহিদার পূর্ণতা নয়, এটি এক দীর্ঘ যাত্রা, যেখানে নৈতিকতা, আত্মসংযম ও বিশ্বাসের পরীক্ষা প্রতিটি বাঁকে আমাদের সামনে দাঁড়ায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ হলো মানব জীবনের একটি স্বাভাবিক ও উত্তম প্রতিষ্ঠান। এটি শুধু সামাজিক বা পারিবারিক কাঠামোর ভিত্তিই নয়, বরং ঈমানের অর্ধেক রক্ষার এক শক্ত প্রাচীর।
হাদিসে এসেছে, “যখন মানুষ বিবাহ করে, তখন সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করল। এরপর বাকি অর্ধেকের ব্যাপারে যেন আল্লাহকে ভয় করে।” (বায়হাকি)
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, যদি কেউ অবিবাহিত থাকে, তবে কি সে হারাম জীবনযাপন করছে? ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এর উত্তর স্পষ্ট। অবিবাহিত থাকা সত্ত্বাগতভাবে হারাম নয়।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, “যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে না, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে, যতক্ষণ না আল্লাহ তাদেরকে তার অনুগ্রহে সচ্ছল করেন।” (সূরা আন-নূর: ৩৩)
এ আয়াত প্রমাণ করে যে বিবাহ সাময়িকভাবে বিলম্বিত হলে বা অসম্ভব হলে অবিবাহিত জীবন নিষিদ্ধ নয়, তবে আত্মসংযম সেখানে অপরিহার্য শর্ত।
রাসুলুল্লাহ সা. যুবকদের উদ্দেশে এক অমোঘ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, “হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য আছে, সে যেন বিবাহ করে। কারণ এটি দৃষ্টি সংযত করে, লজ্জাস্থান রক্ষা করে। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোজা রাখে, কারণ রোজা তার জন্য ঢালের মতো।” (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম)
এই হাদিস যেন অবিবাহিত জীবনের মূল দর্শন তুলে ধরে—পাপ থেকে দূরে থাকতে আত্মসংযমই প্রধান অস্ত্র।
ব্যক্তি বিশেষের অবস্থা অনুযায়ী বিয়ে নানা পর্যায়ে রূপ নেয়। যেমন, সাধারণত বিবাহ সুন্নাত। কোনো ব্যক্তির চারিত্রিক স্খলন বা বড় গুনাহর সম্ভাবনা দেখা দিলে বিয়ে করা ফরজ। যার মধ্যে স্ত্রীর নানাবিধ হক বা অধিকার দেয়ার মোটেও যোগ্যতা নেই, তার পক্ষে বিবাহ করা নাজায়েজ। ক্ষেত্র বিশেষে বিবাহ ওয়াজিব, নফল ও মুস্তাহাবও হয়ে থাকে।
বাস্তব জীবনে অনেকে একা থাকেন—কেউ আর্থিক সংকটে, কেউ উপযুক্ত জীবনসঙ্গী না পাওয়ায়, আবার কেউ সামাজিক বাস্তবতার কারণে। ইসলাম তাদের অপরাধী মনে করেনি। বরং ধৈর্য, তাকওয়া ও ইবাদতের মাধ্যমে এ সময়কে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে।
একা থাকার সময়কে পরিণত করা যায় আত্মশুদ্ধির আয়নায়। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার, জ্ঞানচর্চায় মনোযোগী হওয়ার এবং সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার সোনালী সুযোগ এটি।
তবে অবিবাহিত জীবনের ঝুঁকিও রয়েছে। একাকীত্ব সহজেই নফস ও শয়তানের জন্য উন্মুক্ত দরজায় পরিণত হয়। দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ না করা, অবসরকে অপচয় করা বা অনৈতিক সঙ্গ গ্রহণ করা দ্রুত মানুষকে পাপে জড়িয়ে ফেলে।
তাই ইসলাম এই সময়ে যে জীবনপথ দেখিয়েছে তা হলো—রোজা রাখা, দৃষ্টি সংযম করা, ইবাদত ও কুরআন অধ্যয়নে সময় ব্যয় করা, সৎ বন্ধুদের সাহচর্যে থাকা, এবং প্রলোভনসৃষ্টিকারী পরিবেশ থেকে দূরে থাকা।
অতএব, অবিবাহিত জীবন হারাম নয়, বরং এটি এক পরীক্ষার মঞ্চ। যে এ মঞ্চে আত্মসংযম, তাকওয়া ও ধৈর্যের প্রদীপ জ্বালাতে পারবে, তার অবিবাহিত জীবনও আল্লাহর নৈকট্যের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যে আত্মতুষ্টি, গাফিলতি ও পাপাচারে জড়িয়ে পড়বে, তার জন্য এই জীবন হবে গাফিলতির অন্ধকার গহ্বর।
আজকের সমাজে যখন দেরিতে বিয়ে করা বা দীর্ঘ সময় অবিবাহিত থাকা একটি সাধারণ চিত্র, তখন এ বিষয়ে ইসলামের দিকনির্দেশনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিবাহ সম্ভব হলে দ্রুত তা করা, আর সম্ভব না হলে আত্মসংযমের সঙ্গে বেঁচে থাকা এটিই ইসলামের সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান।
আন্দালুসের প্রাসাদ থেকে শুরু করে সমকালীন মহানগরের একাকী কক্ষ পর্যন্ত যেখানেই হোক না কেন, ইসলামের বার্তা এক, জীবন কখনো পাপের অজুহাত হতে পারে না, প্রতিটি পরিস্থিতি আল্লাহর পরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথ হলো তাকওয়া, জ্ঞান ও নৈতিক দৃঢ়তা।