আবাসন সংকট নিরসন, শিক্ষাবৃত্তি চালু এবং প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট অনুমোদনের দাবিতে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলো আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন আন্দোলনকারীরা।
বুধবার (১৪ মে) দিনভর উত্তপ্ত পরিস্থিতির পর রাতভর রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নেন তারা। বৃহস্পতিবার (১৫ মে) সকালেও সেখানে অন্তত অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারীকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। তাদের অবস্থানের ফলে কাকরাইল মোড় হয়ে যান চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট।
লংমার্চে পুলিশের বাধা, সংঘর্ষে আহত শতাধিক
আন্দোলনের অংশ হিসেবে বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ‘লংমার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের উদ্দেশে রওনা হন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গুলিস্তান, মৎস্য ভবন ও কাকরাইল এলাকায় পুলিশের বাধার মুখে পড়েন তারা। কাকরাইল মসজিদ এলাকায় পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
এ সময় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্যসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। আন্দোলনকারীদের দাবি, হামলাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
রাতভর অবস্থান, সকালে ঘোষণা—‘পিছু হটবো না’
পুলিশি হামলার পরও শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মোড়ে অবস্থান ধরে রাখেন। রাত ২টা পর্যন্ত চলা অবস্থান কর্মসূচি বৃহস্পতিবার সকালেও অব্যাহত থাকে। বিক্ষোভে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিনা শরমিন, ব্যবসায় অনুষদের ডিনসহ শিক্ষক প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
আন্দোলনকারীদের সমর্থনে বিকেলে আরও আটটি বাসে করে কয়েকশ শিক্ষার্থী কাকরাইলে এসে আন্দোলনে যোগ দেন।
আহতদের তালিকায় শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা
আন্দোলনে পুলিশি হামলায় আহত অন্তত ৩৮ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন— জবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. রইছ উদ্দীন, সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহতাব হোসেন লিমন, ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি সোহান ফরাজি, দৈনিক সংবাদের প্রতিনিধি মেহেদী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে রেদোয়ান, আসিফ, রহমান, আকিব, আরিফ, রফিক, আপেল, মুজাহিদসহ অন্তত ৩০ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মাহতাব লিমন ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী সুবর্ণ আস সাইফ গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
প্রশাসনের বক্তব্য ও আলোচনার চেষ্টা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম বলেন, “আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। তবে শিক্ষার্থীরা এখনও সড়ক ছাড়েননি।” তিনি আরও বলেন, “যমুনার সামনে যাওয়ার অনুমতি নেই, শিক্ষার্থীরা পুলিশের ব্যারিকেডের অপর পাশে অবস্থান করছেন।”
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. তাজাম্মুল হক বলেন, “শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ অমানবিক আচরণ করেছে। এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।”
আন্দোলনের পক্ষে প্রশাসন ও সংগঠনগুলোর অবস্থান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ছাত্র সংগঠন, সাংবাদিক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। জবি ছাত্রদলের সদস্য সচিব সামসুল আরেফিন বলেন, “রাজপথ ছাড়বো না, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে সরকারকেই দায় নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো হয়েছে, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করছি।”
তিন দফা দাবির বিস্তারিত
১. আবাসন বৃত্তি: বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে আবাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মাসিক বৃত্তি চালু করতে হবে।
২. পূর্ণাঙ্গ বাজেট: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করে অনুমোদন দিতে হবে।
৩. দ্বিতীয় ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্পকে পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন দিয়ে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
উপসংহার
দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে রয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা বলছেন, “আমরা কোনো রাজনৈতিক স্বার্থে এখানে নেই। এটা আমাদের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। সরকার যদি আমাদের ন্যায্য দাবিগুলো আমলে না নেয়, তাহলে আন্দোলন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে।”