ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে চলছে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিব এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়োগের বিষয়টি
নিয়ে অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে। নিয়োগ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার সুপারিশের চিঠিটি বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এটি এখন পর্যন্ত নথিভুক্ত হয়নি। নিয়োগের বিষয়টি নথিভুক্ত হবে কি না সেটা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন একাধিক কর্মকর্তা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনজিও’র প্রধান মোহাম্মদ এজাজকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পাঠানো একটি সুপারিশকে ঘিরে এই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পাঠানো সুপারিশের একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকেই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টার সুপারিশের কপিটি ভাইরাল হওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। সম্প্রতি চলতি দায়িত্বে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশীদ মিয়ার নিয়োগ কতোটা স্বচ্ছ ছিল- এটা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। আব্দুর রশিদ মিয়া এলজিইডি’র মানবসম্পদ উন্নয়ন, মান নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ ইউনিটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (গ্রেড-৩) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। যোগ্যতা অনুযায়ী কয়েক গ্রেড টপকে তাকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে চলছে সমালোচনা। তাকে এ নিয়োগ দিয়ে মঙ্গলবার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
সূত্র জানায়, পানি সম্পদ ও টেকসই উন্নয়নের বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (জউজঈ) এর চেয়ারম্যান এজাজকে নিয়োগের জন্য বিস্ময়করভাবে সুপারিশ করা হয়েছে। সাধারণত সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন এডমিন ক্যাডার-যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। কোনো ক্যাডারভুক্ত নন এমন ব্যক্তিকে সরকার চাইলে বিশেষভাবে নিয়োগ দিতে পারলেও সেটা সর্বসম্মতিক্রমে হতে হবে।
গত ২৩শে জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানের কাছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পাঠানো এক চিঠিতে এ সুপারিশ জানানো হয়। সুপারিশ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রিয় সিনিয়র সচিব। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে নিয়োজিত আছি। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, স্থানীয় সরকার বিভাগের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কার্যাদি সম্পন্ন করণের জন্য প্রশাসক হিসেবে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা পদায়ন করা প্রয়োজন। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টার, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা এর চেয়ারম্যান জনাব মোহাম্মদ এজাজ একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। তিনি কর্মজীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হলে এই প্রতিষ্ঠানের কাজের গতি বৃদ্ধিসহ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে বলে আমি মনে করি। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একাধিক যোগ্য কর্মকর্তা (সচিব) রয়েছেন। তাদের বাদ দিয়ে একাধিক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পছন্দের এই এনজিও প্রধানকে নিয়োগ দিতে যে সুপারিশ করা হয়েছে এতে ক্ষুব্ধ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সুপারিশ তিনি করতেই পারেন। কিন্তু একজন এনজিও কর্মকর্তা কিভাবে প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি তো এ বিষয়ে যোগ্য ব্যক্তি নন। এখানে উপদেষ্টা তার মন্ত্রণালয় থেকেই বরং যোগ্য একাধিক সচিবকে নিয়োগ দিতে পারতেন। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা সমালোচনা চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি প্রকাশের বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দুষছে। আরেক কর্মকর্তা বলেন, সুপারিশের চিঠিটি আমরা পেয়েছি কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এটি নথিভুক্ত হয়নি। এটা অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হবে। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে তাই এটা বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে। পরবর্তীতে এটা চূড়ান্ত হবে। এক্ষেত্রে নিয়োগটি না-ও হতে পারে। অর্থাৎ বাতিল হতে পারে। প্রসঙ্গত, মোহাম্মদ এজাজ জাতীয় নাগরিক কমিটির পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক সেলের সদস্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এটা চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সরাসরি নিয়োগ দিতে পারেন। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সুপারিশের কপিটি এখন পর্যন্ত আমার কাছে আসেনি। এডমিন ক্যাডার বা যুগ্ম সচিবদের বাদ দিয়ে এনজিও কর্মকর্তাকে নিয়োগের বিষয়টি কতোটা স্বচ্ছ? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তারা চাইলে নিয়োগ দিতে পারেন। তবে যোগ্যতা অনুযায়ী এখানে সাধারণত এডমিন ক্যাডারভুক্ত ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়ে থাকেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এপিডি অনুবিভাগ) মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, নিয়োগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো আমরা কাজ শুরু করিনি। যেহেতু এ ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো ধাপ পার হয়ে চূড়ান্ত করা হয়, তাই সর্বসম্মতিক্রমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে এটা নিয়ে বিতর্ক থাকলে সেটাও নিয়োগ কমিটি বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।