বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) লাইসেন্সিং শাখায় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক নাহিদুল হাসানকে ঘিরে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। অতিসম্প্রতি লাইসেন্সিং শাখায় পদায়নের পর থেকেই তিনি পুরো আইএসপি সেক্টরকে নিজের প্রভাব ও ক্ষমতার আওতায় নিয়ে আসেন বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট মহলের একাধিক ব্যক্তি।
সূত্র জানায়, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নাহিদুল হাসান যাচাই-বাছাই না করেই বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৩০১টি আইএসপি লাইসেন্সকে মেয়াদোত্তীর্ণ দেখিয়ে বাতিল করেন। এর পরপরই শুরু হয় বাতিল হওয়া লাইসেন্স পুনঃসচল করার নামে তদবির, অর্থ বাণিজ্য ও অনিয়মের মহোৎসব। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে লাইসেন্সিং বিভাগের প্রতিটি নথিপত্র তার অনুমতি ছাড়া নড়াচড়া করে না।
এছাড়া, “আইএসপি গাইডলাইন” এবং “আইএসপি সংখ্যা নিরূপণ নীতিমালা” লঙ্ঘন করে তিনি সম্প্রতি একটি জাতীয় (ন্যাশনওয়াইড) আইএসপি লাইসেন্স প্রদানের উদ্যোগ নেন। তবে গত ২৬ এপ্রিল ২০২৫, অনলাইন সংবাদমাধ্যম টেকশোর এ বিষয়টি প্রকাশিত হলে হঠাৎ করেই প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এ নিয়ে এখনো কোনো তদন্ত কিংবা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
কমিশনের ভেতরের একাধিক সূত্র বলছে, নাহিদুল হাসান কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ইএন্ডও বিভাগের কমিশনারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। বরং, কমিশনে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আস্থার প্রতীক হিসেবে তিনি নিজেদের অবস্থান শক্ত করছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিভাগীয় মহাপরিচালক সম্প্রতি কিছু ডিভিশনাল আইএসপি লাইসেন্স বিধি বহির্ভূতভাবে ইস্যু করার দায়ে জড়িত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে শোকজ করেন। এর মধ্যে রয়েছেন সিনিয়র সহকারী পরিচালক জাহিদুল ইসলাম, হামিদুল ইসলাম ও উপ-পরিচালক রাইসুল ইসলাম। কিন্তু নাহিদুল হাসান শাস্তির পরিবর্তে তাদের বদলির জন্য তদবির করেন এবং বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে দেন।
অভিযোগ রয়েছে, লাইসেন্সের বই স্বাক্ষর নিয়েও অনিয়ম করা হয়েছে। শতাধিক লাইসেন্সের বই বিনা অনুমতিতে স্বাক্ষর করে দেওয়া হলেও তার কোনো হিসাব মিলছে না, যা একটি বড় অডিট প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
নাহিদুল হাসানের অতীত ঘেঁটেও দুর্নীতির চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি গোপালগঞ্জের একজন আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান এবং সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর ভাতিজা। এই পরিচয়ের প্রভাবেই কোনো ধরনের লিখিত পরীক্ষা বা মেধা যাচাই ছাড়াই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া নিয়ে অডিট আপত্তিও তোলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, নিয়োগের পর ইন্ডও বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে লাইসেন্সবিহীন আইএসপি দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে নিয়মিত মাসোহারা গ্রহণ করতেন তিনি। DIS বিভাগে দায়িত্ব পালনের সময় ব্যান্ডউইডথ ফাঁকির কারসাজিতে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া, তার পরিচিত একটি ভেন্ডর থেকে সফটওয়্যার কিনতে আইআইজিদের চাপ প্রয়োগ করার অভিযোগ উঠেছে ২০১১-১৩ সময়কালে।
পরবর্তীতে এসএস বিভাগে বদলি হয়ে তিনি এসওএফ ফান্ড বিতরণেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ অনুযায়ী, ঘুষ ছাড়া কেউই বরাদ্দের অর্থ ছাড় করাতে পারতেন না—even মূল কমিটির অনুমোদন থাকলেও।
নাহিদুল হাসানের বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—তিনি তাঁর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন ভারতে, যা এই গোপন তৎপরতার পেছনে প্রভাব ফেলেছে বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।
বিভিন্ন পর্যায়ের অভিযোগ সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত নাহিদুল হাসানের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, যা প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ বিষয়ে স্বতন্ত্র তদন্ত জরুরি—না হলে পুরো লাইসেন্সিং ব্যবস্থায় আস্থা ফিরে আসবে না।